আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গাজায় আকস্মিক মনোযোগে এশীয় মিত্রদের দীর্ঘ প্রত্যাশিত মার্কিন মনোযোগের কেন্দ্রে ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের হাজির হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এশিয়ায় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি গত কয়েক বছরে গতি পেয়েছে। ফিলিপাইন ও ভারতের সঙ্গে নতুন নিরাপত্তা চুক্তি, বিস্তৃত সামরিক মহড়া এবং চীনের প্রযুক্তি থেকে এগিয়ে থাকতে মিত্রদের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ঘূর্ণির মতো ওয়াশিংটনকে ফিরিয়ে এনেছে। ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলে টাস্কফোর্স ও অস্ত্র পাঠানো, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মকর্তাদের সফর, রণতরি মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বেইজিংকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত এগোচ্ছে না বলে ইতোমধ্যে উদ্বিগ্ন ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের মার্কিন মিত্ররা এটিকে ক্ষতি হিসেবে মনে করছেন। তারা মনে করছেন তাদের সামনে থাকা গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার অগ্রগতি আরও বিলম্বিত হবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে।
গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি কৌশলগত ফোরামে জাপানের একজন আইনপ্রণেতা ও সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আকিহিসা নাগাশিমা বলেছেন, আমাদের সবচেয়ে উদ্বিগ্ন করছে পূর্ব এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে সরিয়ে নেওয়া।
মার্কিন সামরিক কমান্ডাররা বলছেন, ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চল থেকে কোনও সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হয়নি। মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্য, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চলতি সপ্তাহে এশিয়া সফরে মিত্রদের আশ্বস্ত করবেন। পৃথকভাবে বা একসঙ্গে তারা দুজন ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সফর করতে পারেন।
সফরে তারা গাজা নিয়ে মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গি শুনতে পারেন। ভারত ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন দিচ্ছে, জাপান একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিতে যাচ্ছে, বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যাযজ্ঞে ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
কিন্তু এই দেশগুলোর আরেকটি প্রশ্ন রয়েছে, দূরবর্তী ইউক্রেনে আরেকটি যুদ্ধে ওয়াশিংটনের জড়িয়ে পড়া নিয়ে। যে যুদ্ধ ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ কিছুটা সরিয়ে রাখছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, বিদেশে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া এবং দেশে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কতটি দেশকে দেওয়া সমর্থনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রক্ষা করতে পারবে?
এ ক্ষেত্রে সাধারণ উদ্বেগের জায়গা হলো অস্ত্র। ইউক্রেন ও ইসরায়েলকে গোলাবারুদ সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্প জটিলতায় পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৫৫ মিলিমিটার কামানের গোলা। গাইডেড অস্ত্র ও আরও জটিল মার্কিন অস্ত্র দুই সংঘাতে বিপুল সংখ্যায় পাঠানো হয়েছে। অথচ ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে মিত্ররা তাদের অস্ত্র সরবরাহ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম পেতে জাপান, তাইওয়ান ও অস্ট্রেলিয়াকে হয়তো আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তাইওয়ানের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যান্ড্রু নিয়েন-ডিজু ইয়াং বলেন, বিষয়টি শুধু সরঞ্জামের নয়। এসব ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। উদ্বেগের কারণ হলো, চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি কার্যকর ও বিপুল ক্ষমতা নেই।
গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে এর প্রভাব বদলে যেতে পারে। দীর্ঘ সংঘাতে মার্কিন অস্ত্রাগারে আরও টান পড়বে, চীন হয়তো শিক্ষা নেবে শহুরে যুদ্ধ চরম কঠিন, সম্ভবত তা বেইজিংকে ঘনবসতিপূর্ণ তাইওয়ান দ্বীপটিকে দখলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া অব্যাহত রাখা থেকে বিরত রাখতে পারে। চীন দ্বীপটিকে নিজেদের হারানো ভূখণ্ড বলে মনে করে।
হামাসের হামলার দুই সপ্তাহ পর ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে চীনের সামরিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু দিন পর রাতে সাগরে মার্কিন বি-৫২ বোমারু বিমানের ১০ ফুট কাছে চলে আসে চীনের একটি যুদ্ধবিমান।
মার্কিন সেনাবাহিনীর ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের কমান্ডার অ্যাডমিরাল জন অ্যাকুইলিনোর মতে, চীনের লক্ষ্য হলো এ অঞ্চল থেকে জোরপূর্বক যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়িয়ে দেওয়া। পেন্টাগন কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, এমনটি কখনও ঘটবে না। কিন্তু এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পালন করা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। মিত্র দেশগুলো এর বাইরে নয়।
নয়া দিল্লির এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো সি. রাজা মোহন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পুরোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও এশিয়ায় উপস্থিতি নিয়ে কাজ করার সম্পর্কে ফিরে গেলে তা তাইওয়ান, জাপান, ভারত ও পুরো অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক চং জা ইয়ান বলেন, ইসরায়েলকে সংযমী হতে বলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনেকে আহ্বান জানিয়ে আসছে। বাইডেন প্রশাসনের সামনে একটি কঠিন কাজ রয়েছে। তাদের অতীতের নীতির বোঝাও বহন করতে হবে।
ইসরায়েলি সংযমের জন্য মার্কিন আহ্বানের প্রতি উল্লেখযোগ্য নিন্দাবাদ রয়েছে।
বুধবার জাপানে ব্লিঙ্কেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির চেয়ে গাজা ও ইউক্রেনে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কি যুক্তরাষ্ট্র? জবাবে তিনি বলেছেন, আমি বলতে পারি আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা একইসঙ্গে দৌড়াচ্ছি ও চুইংগাম চিবুচ্ছি। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেছেন, এমনকি আমরা যখন গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যে একটি বাস্তব সংকট মোকাবিলা করছি, তখনও আমরা ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে আমাদের স্বার্থে পুরোপুরি লিপ্ত হতে সক্ষম।
আপনার মতামত লিখুন :