‘তোমার জন্য রেখে গেলাম লাখো মুক্তিযোদ্ধা, ওরা সবাই তোমার ছেলে’


Assroy প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ৫, ২০২৩, ৮:১০ পূর্বাহ্ন /
‘তোমার জন্য রেখে গেলাম লাখো মুক্তিযোদ্ধা, ওরা সবাই তোমার ছেলে’

আশ্রয় ডেস্ক

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু কিছু চিঠি মুক্তিযুদ্ধের পর ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। তার পরতে পরতে পরিবার ও স্বজনদের জন্য আহাজারি ছিল না—ছিল সম্মানজনক মৃত্যু এবং দেশ স্বাধীনের তাগিদের কথা। তেমন অনেক চিঠি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে, আছে পরিবারের কাছে। তেমনই একটি চিঠি স্বাধীনতার দলিলপত্রের একাদশ খণ্ডে পাওয়া যায়।

কী ছিল ওই চিঠিতে? যোদ্ধা লিখেছেন, ‘তুমি আজ কোথায় জানি না। তোমার মতো শত শত মায়ের চোখের জল মুছে ফেলার জন্য বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। আমি যদি মরে যাই, তুমি দুঃখ করো না মা। তোমার জন্য আমার যোদ্ধা-জীবনের ডায়েরি রেখে গেলাম, আর রেখে গেলাম লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। তারা সবাই তোমার ছেলে।’

মায়ের উদ্দেশে ছেলে তার যুদ্ধদিনের যন্ত্রণার কথা লিখে গিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, ছোট ছোট কাগজে নিজের অনুভূতি লেখা কমন বিষয় ছিল। আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে এমনভাবে টিকে থাকতাম, সেটাই পরিবার হয়ে উঠেছিল।

যে মুক্তিযোদ্ধার চিঠির কথা বলা হচ্ছে তিনি যুদ্ধে আহত হন। সে রাতে মুক্তিযোদ্ধা লিখেছেন— সেদিন তিনি ছিলেন হাসপাতালে। তিনি লিখেছেন, ‘হাসপাতালে শুয়ে তোমার স্নেহমাখা মুখখানি বারবার মনে পড়ছে। আমার ডায়েরিটা তোমার হাতে গেলে তোমার সকল দুঃখ দূর হয়ে যাবে। দেখবে, তোমার ছেলে শত্রুকে পেছনে রেখে কোনোদিন পালায়নি। যেদিন তুমি আমাকে বিদায় দিয়েছিলে আর বলেছিলে—শত্রু দেখে কোনোদিন পেছনে আসিসনি বাবা। তুমি বিশ্বাস কর মা, শত্রু দেখে আমি কোনোদিন পালাইনি। শত্রুর বুলেট যেদিন আমার বুকের বাঁ দিকে বিঁধলো, সেদিনও তোমার কথা স্মরণে রেখেছিলাম।’

‘মা, আমার সবচেয়ে আনন্দ কোথায় জানো? আজ থেকে চার দিন পূর্বে একটি গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ বেদনাক্লিষ্ট একটি নারীকণ্ঠ ভেসে আসলো। কালবিলম্ব না করে সেদিকে দৌড়ে গেলাম। একটা গুলি আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেলো, আবার একটা। আবার বুঝলাম শত্রুরা আমাকে লক্ষ্য করেই গুলি ছুড়ছে, তবু আমি এগিয়ে চলেছি। বাড়িটার পেছনে একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে পজিশন নিলাম। দেখলাম, বিবস্ত্রা একটি নারীদেহ নিয়ে কয়েকজন শত্রু পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠেছে। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না, মা। মনে পড়ে গেলো বাংলার লক্ষ লক্ষ মায়ের কথা। শত্রুকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লাম। ওরাও অনবরত গুলিবর্ষণ শুরু করলো। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে। জানতে পারলাম, আমার গুলিতে ৫ জন নরখাদক পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। দোয়া করো মা। ভালো হয়ে আবার যেন তোমার শত শত সন্তানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারি।’

১৯৭১ সালের এই সময়ে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমাগত পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সৈন্যদের সরিয়ে দিয়ে একের পর এক জায়গা দখল করে নেয়। ৫ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে হানাদার বাহিনী। পরে হানাদার বাহিনীর কিছু সেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়। এদিন আখাউড়া দখলের পর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে যায়।

ভাটারার মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আমাদের সারা দিনের ক্লান্তি ভুলতে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতাম। যারা লেখাপড়া জানতেন, তারা ডায়রি লিখতেন। চিঠিও পাঠানোর চেষ্টা হতো হাতে হাতে, যদিও জানতো না সেটা পরিবারের হাতে পৌঁছাবে কিনা। তবে রণাঙ্গন থেকে পাঠানো এই চিঠি প্রামাণ্য দলিল, এতে যোদ্ধাদের দিন-রাতের প্রকৃত খবর পাওয়া যায়।’