পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত দিবস : দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঐতিহাসিক বিজয়ের সেই দিনগুলো


Assroy প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ৬, ২০২৩, ৮:৩২ পূর্বাহ্ন /
পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত দিবস : দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঐতিহাসিক বিজয়ের সেই দিনগুলো

আশ্রয় ডেস্ক

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটির আগেও পরে দেশের অনেক অঞ্চল আলাদা-আলাদা ভাবে হানাদার মুক্ত হয়েছিলো আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কারণে। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার(বাসস) সংবাদদাতাগণ তাদের নিজ-নিজ এলাকা হানাদার মুক্ত হওয়া দিনের সেই বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের অংশ বিশেষ পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ পূর্ব বাংলার তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণের পরই বাঙালিরা বুঝে যায় দেশে স্বাধীনতার বিকল্প নাই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকায় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ ও ই.পি.আর.কে হত্যা করে এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগের প্রধান ও পূর্ব বাংলার তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হবার আগেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। পরে তাঁর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ফলে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে “বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর পাকিস্তানিদের পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে সারাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে স্বাধীন করতে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে গেরিলা বাহিনী সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে প্রশিক্ষণসহ যথেষ্ট অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য লাভ করে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন তারা গেরিলা বাহিনীর কাছে পরাজয়ের লজ্জা এড়াবার জন্য এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সংঘর্ষে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ৩ ডিসেম্বর ভারতে বিমান হামলার মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
অতঃপর ভারতও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইতোমধ্যে পর্যুদস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করে। এসময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। এরই মাধ্যমে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান হয়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সংবাদদাতাগণের পাঠানো নিজ-নিজ এলাকায় হানাদার মুক্ত হওয়া সেই বীরত্বগাঁথা দিনের ইতিহাসটুকু পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো:
লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস ৪ ডিসেম্বর। মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীপুর ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামসদের লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নৃশংস হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষত-বিক্ষত। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে এ জেলায় পাক-হানাদারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। যুদ্ধের মহাসংকট থেকে মুক্ত হয় জেলাবাসী।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯টি সম্মুখ যুদ্ধসহ ২৯টি দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। এসব যুদ্ধে আবু ছায়েম, সৈয়দ আবদুল হালিম বাসু, রবিন্দ্র কুমার সাহা, মাজহারুল মনির সবুজ, মুনছুর আহম্মদ, চাঁদ মিয়া, মো. মোস্তফা মিয়া, জয়নাল আবেদিনসহ ৩৫জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং হাজার-হাজার নিরীহ মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সদর উপজেলায় ২৩ জন, রামগতিতে ২জন, কমলনগর ১জন, রায়পুরে ৭জন ও রামগঞ্জে ২জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বপ্রথম শহরের মাদাম ব্রিজ বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেন। আজও এর স্মৃতি হিসেবে পুরাতন ব্রিজটির লোহার পিলার দাঁড়িয়ে আছে।
৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন এ জেলায় উল্লেখযোগ্য রণক্ষেত্রগুলো হল- কাজির দিঘীর পাড়, মিরগঞ্জ, চৌধুরী বাজার, দালাল বাজার, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা, বাসু বাজার, ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, চর আলেকজান্ডার, প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, রামগঞ্জ হাই স্কুল এবং রামগঞ্জের গোডাউন এলাকা।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা জেলার বিভিন্ন স্থানে নারকীয় তান্ডব চালায়। হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প ছিল জেলা শহরের বাগবাড়ি এলাকায়। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী মানুষদের তুলে এনে এই ক্যাম্পে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালাতো। এখানেই অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়। হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী মানুষ গুলোকে হত্যা করে রহমতখালী খালে ভাসিয়ে দিতো, আবার গর্ত করে মাটিতেও পুতে ফেলতো। যার প্রমাণ জেলা শহরের বাগবাড়িস্থ গণকবর।
১৯৭১ সালের ২১ মে গভীর রাতে লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর ও দক্ষিণ মজুপুর গ্রামের হিন্দু পাড়ায় পাক-হানাদার বাহিনী ভয়াবহ তান্ডবলীলা চালায়। বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে, বহু মানুষকে গুলি ও রাইফেলের মাথার বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এ সময় ১১টি বাড়ির ২৯টি বসতঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে আগুনে দগ্ধ হয়ে ও হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারায় প্রায় ৪০জন নিরস্ত্র বাঙালি। এ সব নারকীয় হত্যাযজ্ঞের আজও নীরব স্বাক্ষী হয়ে আছে শহরের বাগবাড়িস্থ গণকবর, মাদাম ব্রিজ বধ্যভূমি, পিয়ারাপুর ব্রিজ ও মজুপুরের কয়েকটি মুসলিম ও হিন্দু বাড়ি।
একাত্তরের ১ ডিসেম্বর প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হায়দার চৌধুরী এবং সুবেদার আব্দুল মতিন, আ ও ম শফিক উল্যা, হামদে রাব্বীর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সাঁড়াশি অভিযান চালায়। অবশেষে ৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের অনেকে।
লক্ষ্মীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার হুমায়ুন কবির তোফায়েল বাসসকে বলেন, ‘পাক হানাদার বাহিনীর গতিরোধ করতে জেলা শহরের মাদাম ব্রিজটি বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে পাক-বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের অসংখ্য নর-নারী হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। সেই স্মৃতি আজও আমাদেরকে কাঁদায়।’
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে প্রতারকদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তারা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য দৌঁড়ঝাপ করছে। অথচ আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি শুধুমাত্র দেশ ও মানুষের স্বার্থে।’
দেবীদ্বার  : কুমিল্লার দেবীদ্বার মুক্ত দিবস ৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এ দিনে দেবীদ্বার পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সলের রক্তে ঝরা দিনগুলোতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল। তারই ধারাবাহিকতায় দেবীদ্বার এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথভাবে ওইদিন হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে। ৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ‘কুমিল্লা-সিলেট’ মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিষ্ফোরনে উড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্ড ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর.ডি হিরা’র নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এ অভিযান পরিচালিত হয়। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং ব্রাক্ষণপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। হানাদাররা ওই রাতেই দেবীদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ দেবীদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ দিনে দেবীদ্বারের উল্লাসিত জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে বিজয় উল্লাসে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে মেতে উঠে। দুপুর পর্যন্ত ওইদিন হাজার-হাজার জনতা বিজয় উল্লাসে উপজেলা সদর প্রকম্পিত করে তোলে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কসবা এলাকায় নারকীয় এক হত্যাজজ্ঞ চালিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সু-সজ্জিত ১৫ সদস্যের একটি পাক সেনার দল, পায়ে হেঁটে ‘কুমিল্লা-সিলেট’ মহাসড়ক হয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি বর্তমান কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে যাত্রা শুরু করে। ৩১ মার্চ কাক ডাকা ভোরে ‘কুমিল্লা-সিলেট’ মহাসড়কের দেবীদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়ি নামক স্থানে ওই হায়নার দলটিকে জনতা প্রথম অবরুদ্ধ করে। পাক সেনারা ধাওয়া খেয়ে দেবীদ্বার পৌর এলাকার চাপানগর গ্রামে ঢুকে এক গৃহবধূর শ্লীলতা হানীর চেষ্টাকালে আবুল কাসেম নামে এক যুবক ইট দিয়ে আঘাত করলে পাক সেনাদের গুলিতে তিনি প্রথম শহীদ হন। বিক্ষুব্ধ জনতা দেবীদ্বার থানার অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে ওই অস্ত্র এবং বঙ্গজ হাতিয়ার লাঠি, দা, সাবল এমনকি মরিচের গুড়াও শক্র নিধনে ব্যবহার করেছিল সেদিন। শক্রসেনারা কোড়েরপাড় পৌছার পর হালচাষরত কৃষক সৈয়দ আলী শক্রসেনাদের দেখে হাতের পাজুন দিয়ে পাক সেনাদের পেটাতে থাকে, পাকসেনাদের গুলিতে সহকর্মী মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে আব্দুল মজিদ ঝাটা নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করে হায়ানাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে শহীদ হন।
এমনি করে ভিংলাবাড়ি থেকে জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ পর্যন্ত পনের কিলোমিটার পথে হাজার-হাজার নিরস্ত্র ও সশস্ত্র বাঙ্গালীর সাথে পাক হায়নাদের দিনব্যাপী যুদ্ধে পথিমধ্যে আট পাকসেনাকে হত্যাপূর্বক মাটিতে পুতে ফেলে এবং জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদটিকে ব্যাঙ্কার বানিয়ে আশ্রয় নেয়া অবশিষ্ট সাত জনকে হত্যাপূর্বক বস্তা বন্দি করে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়েছিল। পরবর্তীতে প্রখ্যাত রাজাকার আফসু রাজাকার এবং আলী আহাম্মদ রাজাকারের নেতৃত্বে এ এলাকাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। ‘ভিংলাবাড়ি- জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ যুদ্ধ’ খ্যাত ওই যুদ্ধে আবুল কাসেম, সৈয়দ আলী, আব্দুল মজিদ, তব্দল ড্রাইভার, মমতাজ বেগম, সফর আলী, নায়েব আলী, সাদত আলী, লালমিয়া, ঝারু মিয়া, আব্দুল ড্রাইভার, ফরিদ মিয়া, আব্দুর রহিমসহ ৩৩ বাঙ্গালী শহীদ হয়েছিলেন। ।
কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিউল অহমেদ বাবুল বাসসকে জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত ‘বিশেষ গেরিলাবাহিনী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কমরেড আব্দুল হাফেজ, পালাটোনা ক্যাম্প প্রধান কিংবদন্তী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আজগর হোসেন মাস্টার, সাবেক এমএলএ আব্দুল আজিজ খান, শহীদ নুরুল ইসলাম, শহীদ শাহজাহানসহ অসংখ্য কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধার অবদান ছিল স্মরণীয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট দেবীদ্বারের খুব কাছে থাকার কারণে এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যেমন বেশী ছিল, তেমনি রাজাকারদের সহযোগিতায় এ অঞ্চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, লুন্ঠন, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে এ এলাকার মানুষ। এছাড়াও সমতট রাজ্যের রাজধানী খ্যাত এবং হিন্দু অধ্যুসিত বরকামতা গ্রামে পাক হানাদাররা হামলা চালানোর সংবাদে কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হাফেজের নেতৃত্বে প্রায় পাঁচ হাজার বাঙ্গালী মাত্র দু’টি রাইফেল ও লাঠি নিয়ে শক্রসেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। রাইফেলের গুলিতে এক প্লাটুন সৈন্যের পাঁচজন লুটিয়ে পড়লে কিংকর্তব্য বিমূঢ় পাক সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ওই রাতে ফিরে এসে  হায়নারা লুটপাট, নির্যাতনসহ অগ্নিসংযোগে পুরো গ্রামটি জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়।

ফেনী : ফেনী মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর। ফেনীতে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের সকালটা এসেছিল অন্যরকমভাবে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রক্তাক্ত এ জনপদে সেদিন এসেছিল প্রতিক্ষিত ‘মুক্তি’। জনপদে স্বাধীনতার প্রথম সকাল।
১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর হটিয়ে ফেনীকে দখলমুক্ত করে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়। ওইদিন সকাল থেকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা ২নং সাব সেক্টর কমান্ডার ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা লে. কর্নেল জাফর ইমামের (বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিকামী মানুষের দল লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে ফেনী শহরে প্রবেশ করে।
সেদিন সকালটা যেমন ছিল :
৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হাতে জিম্মি ছিল ফেনী। ফলে সেদিন সকালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে অনেকেই হকচকিত হয়ে ওঠেন। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ স্লোগান প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেননি- সত্যিই আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অনেকেই পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে দেখতে পান। তখন লোকজনের ভুল ভাঙতে শুরু করে এবং ধীরে-ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষ মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেন।
৬ ডিসেম্বর সকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম তাঁর ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ বইতে লিখেন, ‘বিজয়ের বেশে আমরা যখন ফেনী প্রবেশ করলাম ক্ষণিকের মধ্যে ফেনী শহরে জনতার ঢল এসেছিলো। শুরু হয় বিজয় মিছিল। জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। রাস্তায় জনগণ যেখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে সেখানেই তাৎক্ষণিক তারা আলিঙ্গন করে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। অনেকে ছোট-ছোট ছেলে মেয়েদেরকে কোলে করে রাস্তা পরিদর্শন করছিল। রাস্তার দুপাশ থেকে জনতা দু’হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। মিছিলে মিছিলে শোভা পাচ্ছিল বাংলাদেশের পতাকা। অনেককে বিজয়ের আনন্দে কাঁদতে দেখেছি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে খাজা সাহেব (খাজা আহম্মদ) কিছুক্ষণ পর ফেনী পৌঁছেছিলেন। আমার সাথে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর বৃহত্তর অংশ ফেনী প্রবেশ করে। ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের পেছন থেকে আমাদেরকে অনুসরণ করে ও ফেনী অভিমুখে যাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ফেনী কলেজের প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান খান, তৎকালীন ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবদীন হাজারী, গোলাম কাদের আরও অনেকেই আমাদের সাথে ছিলেন। ফেনীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় একই সময়ে শহরে প্রবেশ করে ভিপি জয়নাল, করিম হাজারী, নুর মোহাম্মদ হাজারী, মো. সালেহ আহম্মদ সালু, আবদুল মোতলেব, কাজী নুর নবী, শ্যামল বিশ্বাস, এডভোকেট মুসা মিয়া, জাহাঙ্গীর কবির। সবাই সেদিন বিজয়ের আনন্দে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন।’
সেদিনের বিবরণ দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাক হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে ফেনীর সব সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে ৫ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এ সংবাদ শুনেই জয় বাংলা শ্লোগান ও করতালির মধ্য দিয়ে ফেনীর রাজাঝির দিঘীর পাড়ে সার্কিট হাউজে ও ট্রাংক রোডের প্রেস ক্লাব ভবনের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা ও হাজার-হাজার মুক্তিকামী মানুষ একত্রিত হতে থাকে।
তিনি জানান, ২নং সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সকালেই ফুলগাজীর বন্দুয়া থেকে এসে ফেনী সার্কিট হাউজে (বর্তমান ফেনী সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউজ) প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিকালের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক জয়নাল আবদীন ভিপির নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী রাজাপুর, কোরাইশ মুন্সী ও সোনাগাজীর নবাবপুর থেকে ট্রাংক রোডে চলে আসে। সন্ধ্যায় সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা সমাবেশ করেন।
গেরিলা যুদ্ধের বিবরণ দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবদীন ভিপি বলেন, ডিসেম্বরের শুরুতেই গেরিলা যুদ্ধের নীতি ‘হিট অ্যান্ড রান’ প্রয়োগ করে যুদ্ধ করতে করতে আমরা পাঁচগাছিয়া এলাকার কাছাকাছি চলে আসি। রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এদিকে এসে হিট (হামলা) করে আবার চলে যাই। ৫ ডিসেম্বর আমরা ঠিক ফেনীর কাছাকাছি যখন আসি তখন পাক সেনাবাহিনী রণভঙ্গ দিয়ে শেষ রাতের দিকে শুভপুর ও বারইয়ারহাট হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ফেনীর আশপাশে থাকা পাক বাহিনী কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। তখন আমাদেরকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয় শহরের দিকে আসতে। বিলোনিয়ার দিক থেকে জাফর ইমাম ও সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলামরা সবাই শহরের ট্রাংক রোডে প্রবেশ করল। আমরা পশ্চিম দিক থেকে এসে তাদের সাথে মিলিত হলাম। সেই থেকে ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনী জেলার (তৎকালীন ফেনী মহুকুমার) স্বাধীনতাকামী জনগণের রয়েছে অভাবনীয় বীরত্বগাথা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে তিন দিক থেকে ফেনীর রয়েছে সীমান্ত। ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ফেনীতে ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ফেনী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে শুভপুর ও বিলোনিয়া যুদ্ধ অন্যতম। মরহুম খাজা আহমদের নেতৃত্বে ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা দেরাদুন ও চোত্তাখোলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং সাব-সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমামের নেতৃত্বে বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি অনন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। যার রণকৌশল বিশ্বের বিভিন্ন মিলিটারী একাডেমীতে পাঠ্যক্রম ভুক্ত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়। খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪ জন বীর উত্তম, ৭ জন বীর বিক্রম এবং ২০ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তঝরা স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংস বর্বরোচিত অত্যাচার – গণহত্যা – মা বোনদের ধর্ষণ সহ ধংসাত্মক কর্মকান্ডে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ফেনী জেলার বিভিন্নস্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। লাশ ফেলা হয় পুকুর, খাল, নদী, ডোবা-নালায় ও গভীর জঙ্গলে। ফেনীর বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ফেনী সরকারি কলেজ এলাকার বধ্যভূমি, দাগনভূঁঞার রাজাপুর স্কুল এন্ড কলেজ সংলগ্ন চৌধুরী বাড়ির পার্শ্বে অরক্ষিত বধ্যভূমি, ফুলগাজীর জামমুড়া গ্রামের বধ্যভূমি, পরশুরামের মালিপাথর বধ্যভূমি ও একই উপজেলার সলিয়া বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। এসব বধ্যভুমি ছাড়াও শত সহস্র শহীদের রক্তে রঞ্জিত এ মাটি। স্বাধীনতার ৪৯ পার হলেও বেশির ভাগ গণকবর চিহ্নিত হয়নি।
যশোর : যশোর হানাদার মুক্ত হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের এইদিন বিকেলের আগেই মুক্তিসেনাদের সহায়তায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী পৌঁছে যায় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে তখন খালি। পাকসেনারা তার আগেই ক্যান্টনমেন্টে ছেড়েছে চলে গেছে। মুক্তিসেনারা দেখতে পায় খাবার টেবিলের প্লেটে খাবার। পড়ে আছে ভাত তরকারি। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতে খাবার ফেলেই স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ সন্ধানে পাকসেনাদের পলায়ন ঘটে।
যুদ্ধ চলাকালিন বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনীর উপ-প্রধান রবিউল আলম বলেন, ৩ মার্চ ৭১ যশোর কালেক্টরেটের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে যশোরবাসী শপথ নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধের। শহরের রাজপথে বের হয় মিছিল। এই মিছিলে গুলি চললে শহীদ হন চারুবালা ধর। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই যশোরের প্রথম শহীদ। এরপর থেকেই যশোরে সংগঠিত হতে থাকে প্রতিরোধ। নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতে থাকে ছাত্র, যুবক ও মহিলাদের। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী তদানীন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য জননেতা মশিউর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে। ২৯ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী যশোর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়। ৩১ মার্চ নড়াইল থেকে হাজার-হাজার লোকের বিশাল মিছিল আসে। শহরবাসীর সাহায্যে সশস্ত্র মিছিলটি হামলা চালায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুক্তি পায় সব রাজবন্দী। এর আগে ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে। পাকবাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই এখানে শহীদ হন।
রবিউল আলম জানান, জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচন্ড আক্রমণ চালাতে থাকে। যশোর মুক্তিযুদ্ধের ৮নং রণাঙ্গন। কমান্ডার ছিলেন তদানীন্তন মেজর মঞ্জুর। অন্যদিকে, পাক বাহিনীর মোতায়েন ছিল ১০৭নং ব্রিগেড। এর কমান্ডার ছিলেন বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুবাহিনী ৬টি জেলা নিয়ন্ত্রণ করত।
২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে অভিযান শুরু করে। পাক বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চালের শক্তিশালি ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে সম্মিলিত বাহিনী। মিত্র বাহিনীর গোলার আওতায় আসে যশোর সেনানিবাস। ২২ নভেম্বর রাতে পতন হয় চৌগাছার। হানাদার বাহিনী সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এসময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। এ অঞ্চলের পাক বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান প্রাণ ভয়ে তার অফিস স্থানান্তর করেন খুলনায়। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান শুরু হয় ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাক বাহিনী পালিয়ে যায় খুলনার দিকে।
৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর থেকেই মুক্তি বাহিনী যশোর শহরে প্রবেশ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মুক্ত শহরে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা। স্বাধীনতার আকাংক্ষা বুকে লালন করে চোখের জল মোছেন চৌগাছার মশ্মিমপুরের আইয়ুব আলীর মা। বালক আইয়ুব আলী একমাত্র অপরাধ সে আওয়াজ তুলে ছিল ‘জয় বাংলা’। এই অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এমনি অনেক ত্যাগের ও বেদনার কাহিনী ছড়িয়ে আছে যশোর জেলার সর্বত্র।
পাক হানাদার ও তাদের সহযোগী রাজাকার আল-বদরদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন আইনজীবীদের মধ্যে মশিউর রহমান সুশীল কুমার রায়, সৈয়দ আমির আলী ও আব্দুর রসিদ খান, বাঘারপাড়া থানা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আব্দুল কাদের, আবু তালেব, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ সুলতান অধ্যাপক নবীন চন্দ্র, বিশিষ্ট ব্যবসাহী নারায়ণ সাহা, সমাজ সেবী সুধির ঘোষ, নাট্য অভিনেতা অমল সোম, চিকিৎসক ওবায়দুল হক, মাহফুজ আসাদ, তোজো, মানিক, শান্তি, নজরুলসহ অসংখ্য বাঙালী সন্তান।
হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জ মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এইদিনে হবিগঞ্জবাসী পেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ। দীর্ঘ ৯ মাসের অবরুদ্ধ পরিবেশের অবসানে আনন্দে উদ্বেল হবিগঞ্জবাসী স্বজন হারানোর বেদনায় থমকে গিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে ৫ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের পর হবিগঞ্জ শহরে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর শোনার জন্য শহরবাসী রেডিওতে কান পেতেছিলেন। এর ক’দিন আগেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শায়েস্তানগর, উমেদনগর ও খোয়াই নদীর ওপার থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক গুলিবর্ষণের মাধ্যমে তাদের আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছিলেন। শায়েস্তানগর এলাকায় বর্তমানের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের স্থানে হানাদার পাকিস্তানি মিলিশিয়াদের একটি ক্যাম্প ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে পর্যুদস্ত হয়ে তারা আগেরদিনই শহর ছেড়ে চলে যায়। পাকিস্তানীদের দালাল এডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুল¬া’র শায়েস্তানগরস্থ বাসভবনে হামলা চালাতে গিয়ে রাজাকারের গুলিতে নিহত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম মাসুদ। তিনি শহীদ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা শহরে আর কোন প্রতিরোধের সম্মুখিন হননি। রাজাকার, আলবদর আর সামস্ বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের মুখে আগের রাতেই শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
৬ ডিসেম্বরে শীতের সকালে শহরবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানায়। তারা ‘জয় বাংলা’ শ্লে¬াগান দিয়ে মুক্ত হবিগঞ্জ শহরের রাস্তায় নেমে এসে বিজয়ের উল্ল¬াস প্রকাশ করে।
মুক্ত হবিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি প্রথমে প্রবেশ করে তার নেতৃত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স নায়েক আব্দুস শহীদ। তার সাথে ছিলেন সদর উপজেলার বহুলা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ, মশাজানের বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার আব্দুল কাইয়ুম, সুলতান মামদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আজিম, সুলতানশীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক, হবিগঞ্জ পৌর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবু মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা রইছ আলী, উমেদনগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মিয়া, বাহুবলের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিব মিয়া, রাজিউড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলফু মিয়াসহ ৩৫ জন। তারা সকাল ১০টা-১১ টার দিকে পইলের সড়ক দিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। এর আগে তাদের অবস্থান ছিল সাবাসপুর, বক্তারপুর ও সুয়াইয়া গ্রামে। দলটি শহর প্রদক্ষিণ করে হবিগঞ্জ থানায় গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে জে কে এন্ড এইচ কে হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় স্থানীয় জনগন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স নায়েক আব্দুস শহীদ বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ সদর ইউনিটের কমান্ডার। তিনি জানান, তার নেতৃত্বে ৩ নং সেক্টরের একটি প্লাটুন ২ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ শহরের পাশে অবস্থান গ্রহন করেন এবং পাকিস্তান বাহিনীর দু’জন দালালকে আটক করে হত্যা করা হয়। পরে ৫ ডিসেম্বর ঘেরাও করা হয় হবিগঞ্জ শহর। ওইদিনই হানাদার পাক সেনার পালিয়ে যায়। ৬ ডিসেম্বর সকালে বীর মুক্তিযোদ্ধারা হবিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে এবং থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।
একইদিন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট ও নবীগঞ্জ উপজেলাও হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়।
লালমনিরহাট : লালমনিরহাট মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে লালমনিরহাট পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে এদিন দখলদার পাকিস্তানি সেনারা লালমনিরহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। শত্রুমুক্ত হয় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এবং রংপুরের বিরাট এলাকা।
লালমনিরহাটের সাবেক মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজবাউদ্দিন জানান, ১৯৭১ সালের ছয় ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা লালমনিরহাট শহরকে ঘিরে চারিদিক দিয়ে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।কয়েকটি স্থানে হানাদার পাকিস্তানি সেনাদেও সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা ও মরণপন লড়ায়েই কারণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।পাকিস্তানি সেনারা তাদের দোষর রাজাকারদের শহরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাহারায় রেখে একটি বিশেষ ট্রেনে অবাঙ্গালী বিহারিদের নিয়ে নিরাপদে রংপুরে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি বুঝতে পেরে তিস্তা রেলসেতুর মুখে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সন্ধ্যার একটু আগে তিস্তা রেলওয়ে সেতুর কাছে ট্রেনটি পৌঁছানো মাত্রই বীর মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে দ্রুত রংপুর অভিমুখে পালিয়ে যায়। এসময় পলায়নপর পাকিস্তানি সেনারা তিস্তা রেলসেতুর একটি গার্ডার বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়।
তিনি জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে পর্যুদস্থ হানাদার পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ায় ততক্ষনে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম এবং রংপুরের বিরাট এলাকা পাকিস্তানিদের দখলমুক্ত হয়ে যায়। লালমনিহাটে তিস্তা সেতুর যুদ্ধে জয়ের ঘটনা দ্রুত লোখমুখে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ আনন্দ মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানি বাহিনীর দোষর রাজাকাররা কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পেরে পালিয়ে যায়। এভাবেই সেদিন লারমনিরহাট শত্রুমুক্ত হয়ে যায়।
বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছালাম জানান, সেদিনের প্রতিরোধযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর এজাজসহ বেশ কয়েকজন সৈনিক নিহত হয়।আহত হয় শতাধিক পাকিস্তানি সৈনিক। সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুতে পলায়নপর পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বপূর্ণ জয়ের সূচনা করেন।
এদিকে, লালমনিরহাট মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা তোরণসহ বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। দিনটিতে প্রশাসনের সকল ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এতিমখানা, হাসপাতাল ও কারাগারে উন্নত খাবার পরিবেশন করা হবে। মসজিদে মোনাজাত এবং মন্দিরসহ বিভিন্ন উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
মেহেরপুর : মেহেরপুর মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র ভূমি মুজিবনগর-মেহেরপুর জয় বাংলা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। বিজয় উল্লাসে ফিরে আসতে শুরু করে ভারতে আশ্রিত মেহেরপুর- মুজিবনগরের মানুষ। কারণ ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর তথা মেহেরপুর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতি বছর দিবসটি মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে মুক্ত দিবস হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় একে একে ভেঙে পড়ে পাকিস্তানের সামরিক বলয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ৫ ডিসেম্বররাত থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী গোপনে মেহেরপুর ছেড়ে পালাতে থাকে। ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করলে অবরুদ্ধ জনতা মিত্র বাহিনীর সঙ্গে জয়ের উল্লাসে যোগ দেয়। চারদিক থেকে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে মেহেরপুর। ভারতে আশ্রিত মানুষ জয় বাংলা স্লোগানে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করে। এবং লুকিয়ে রাখা লাল স বুজরেপতাকা দৃষ্টিকাড়া স্থানগুলোতে টাঙ্গিয়ে দেয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ডাকে স্বাধীনতার সূতিকাগার মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। এরপরই তৎকালীন মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক ই ইলাহির সক্রিয় ভূমিকায় ছাত্র-জনতা, আনসার-মুজাহিদদের নিয়ে মুক্তি বাহিনী গড়ে তোলা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ ঘটনার বর্ণনা দেন জেলার প্রবীণ সাংবাদিক মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক তোজাম্মেল আযম। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রথম সরকারে শপথ গ্রহণের পর মেহেরপুর কার্যত হানাদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সে অনুযায়ী ১৮ এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে সড়ক পথে মেহেরপুর প্রবেশ করার সময় সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামে হামলা চালায়। সেদিনই এ অঞ্চলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে মেহেরপুর সরকারি কলেজ, ভকেশন্যাল ট্রেনিংইন্সিটিউট (ভিটিআই) ও কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলসহ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের শক্তিশালী দুর্গ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে দিশেহারা পাক সেনারা মেহেরপুর থেকে পালাবার সময় দিন দত্তব্রিজ, খলিশাকুন্ডি ও তেরাইল ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে বৈদ্যুতিক বিভিন্ন স্থাপনা। এসময় কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিকপরিসংখ্যন কারও জানা নেই।
ভীত সন্ত্রস্ত জনসাধারণ ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি ত্যাগকরে এ জেলার সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রতিরোধ যুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক-আনসার-মুজাহিদরা ও ভারতের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিতে থাকেন। সেই সঙ্গে ভারতের হৃদয়পুর, বেতাই, শিকারপুর, করিমপুর, কাচুলিয়া, বিহারসহ বেশ কয়েটি জায়গায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়।
ভারতীয় বাহিনীর তত্তাবধানে বাংলাদেশি তরুণরা গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রথম অবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র না পাওয়ায় তাদের মনোবল ভেঙে পড়লেও দেশ স্বাধীনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেকেই পাকসেনাদের ক্যাম্পাস লুট করে সে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বশির আহমেদ জানান, পাক সেনারা মেহেরপুর ছেড়ে গেলে সরকারি কলেজ ও ওয়াপদা মোড় এলাকার গণ কবরগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়। সেসব হাড় গোড় কলেজ মোড়ে পৌর গোরস্থানের পাশে সমাহিত করা হয়। নাম নাজানা অসংখ্য শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় পরবর্তীতে সেখানে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিসৌধ।
মাগুরা : মাগুরা মুক্ত দিবস ৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এ দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিহানাদার মুক্ত হয় মাগুরা। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎকালীন মাগুরা মহাকুমায় ব্যাপক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
মাগুরাকে শত্রু মুক্ত করতে শ্রীপুরের আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বাধীন শ্রীপুর বাহিনী, মহম্মদপুরের ইয়াকুব বাহিনী, মহম্মদপুর-ফরিদপুর অঞ্চলের মাশরুরুল হক সিদ্দিকী কমল বাহিনী, মাগুরা শহরের খন্দকার মাজেদ বাহিনী এবং লিয়াকত হোসেনের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক সাহসী ভূমিকা নিয়ে পাক সেনা ও স্থানীয় রাজাকার আল বদর বাহিনীর সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করে। গেরিলা বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। ৬ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী নিজনান্দুয়ালী গ্রামসহ বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। একই সাথে মিত্রবাহিনীর আগ্রাসনের ভয়ে পাকিস্তানী সেনারা রাতারাতি মাগুরা শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ৭ ডিসেম্বর মাগুরা শত্রুমুক্তির আনন্দে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে সারা শহরে। জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা মাগুরা এলাকা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যমত সংগঠক ভারতের রানাঘাট যুব ক্যাম্পের ইনচার্জ এমপি আছাদুজ্জামান মাগুরার মুক্তি বাহিনীকে দিক নির্দেশনা, যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করতেন। ৭ ডিসেম্বর বিকেলে সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আছাদুজ্জামান মিত্রবাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত সেনাপতি মেজর চক্রবর্তীর সাথে সাজোয়া যানে মাগুরায় প্রবেশ করেন এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক সাবেক এমপি আছাদুজ্জামান মাগুরার সকল প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাগুরা নোমানী ময়দানে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সম্মিলিত কুজকাওয়াজে আছাদুজ্জামান অভিবাদন গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে মাগুরাকে পাকহানাদার মুক্ত বলে ঘোষণা করেন।
নোয়াখালী : নোয়াখালী পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত দিবস ৭ ডিসেম্বর । এদিন জেলা শহর মাইজদী প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এ রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি দখলের মধ্য দিয়ে নোয়াখালীর মাটিকে মুক্ত করে লাল সবুজের বিজয় নিশান উড়িয়েছিল মুক্তিসেনারা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর প্রায় এক মাস ধরে নোয়াখালীকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন মুক্তিকামী মানুষ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পদে-পদে বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনারা ২৩ এপ্রিল নোয়াখালী জেলা শহরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা কয়েক দফায় সদরের সোনাপুর, শ্রীপুর, গুপ্তাংক, রামহরিতালুক, বেগমগঞ্জের কুরীপাড়া, গোপালপুর ও আমিশাপাড়ায় নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনী গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা করে প্রায় দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে। গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে মাঠে নামে পাক-হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে। কোম্পানীগঞ্জের বামনী, তালমাহমুদের হাট, ১২ নং স্ল্যুইস গেইট, সদরের উদয় সাধুর হাট (ওদারহাট), করমবক্স, বেগমগঞ্জের ফেনাকাটা পোল, রাজগঞ্জ ও বগাদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মূখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা।
নোয়াখালীকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি যখন প্রায় চুড়ান্ত, ঠিক তখনই ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে মাইজদী পিটিআই ও বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুল ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানিরা। এ সময় বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কের বগাদিয়া ব্রিজ অতিক্রম করতেই সুবেদার লুৎফুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীর হামলায় অসংখ্য পাক সেনা ও মিলিশিয়া মারা যায়।
মুক্ত দিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তযুদ্ধকালীন সি-জোন কমান্ডার এবং বর্তমান সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের জেলা সাধারণ সম্পাদক মো. মোশারেফ হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালে ৭ ডিসেম্বর ভোররাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করার চুড়ান্ত অপারেশন শুরু করেন। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা সংলগ্ন টেকনিক্যাল হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প মুক্ত করে এবং একই দিন সকাল ৯ টার মধ্যে জেলা শহর মাইজদি বাজার ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, নাহার মঞ্জিল, রৌশনবাণী সিনেমা হল, দত্তেরহাট ও সোনাপুর কোল্ড স্টোরেজ এর রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। সকাল থেকে পাক সেনা ও রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি মাইজদি পিটিআই থেকে থেমে-থেমে গুলি বর্ষণ করলে, মুক্তিযোদ্ধারা পাল্ট গুলি বর্ষণ করে। সন্ধ্যা ৫ টায় চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে মাইক দিয়ে আতœসমর্পনের জন্য বলি। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ না করলে, ফেনী থেকে মর্টার শেল এনে নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম দু’টি মর্টার শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তৃতীয়টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। মর্টার শেলের শব্দে কেঁপে উঠে পুরো শহর। বিপরীত দিক থেকে আসা গুলি বন্ধ হলে, মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে দেখতে পান সেখানে ১০/১২ জন রাজাকারের লাশ পড়ে রয়েছে এবং কয়েকজন রাজাকার আত্মসমর্পন করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। এভাবে শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী। বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠে মুক্তিকামী জনতা। শহরের কোর্ট বিল্ডিং এ উড়ানো হয় জাতীয় পতাকা।
বরুড়া : কুমিল্লার বরুড়া মুক্ত দিবস ৭ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের এদিনে বরুড়া পাক হানাদার বাহিনীর রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ আর নির্যাতনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীসহ সর্বস্তরের জনগণের উল্লাস ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে বরুড়া। মুক্ত হয় বরুড়া।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সাড়াশী আক্রমণে পাক সেনারা তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে বরুড়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় বলে জানান, তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অধ্যাপক নূরুল ইসলাম মিলন। রাতের মধ্যে বরুড়া ঘাটিতে অবস্থানরত পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে পাকসেনাদের প্রধান ঘাঁটি পতনের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর বরুড়া পাক সেনা মুক্ত হয়।
সেদিন ভোরে মুক্তিসেনারা বরুড়ার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে আনন্দ উল্লাস করে শহরে প্রবেশ করে। তখন বরুড়ায় জনতার ঢল নামে। বরুড়ার আপামর জনগণ সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নেয়। পরে এদিন বিকেলে বরুড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী ও জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
ঝালকাঠি : ঝালকাঠি মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এইদিনে ঝালকাঠি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয়। জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঝালকাঠির নিয়ন্ত্রণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। ২৭ এপ্রিল হেলিকপ্টার ও গানবোটের মাধ্যমে ঝালকাঠি আক্রমন করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী।পরে পাকিস্তান বাহিনী শহরের দখল নিয়ে দেশের অন্যতম এ বাণিজ্য বন্দরে আগুন লাগিয়ে দেয়।পুড়ে ছাঁই হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার সম্পদ।এরপর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনী তাদের দোষর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহায়তায় নির্বিচারে গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, পাকিস্তানি বাহিনী শহরের পালবাড়ির একটি দ্বিতল ভবনে ‘টর্চারসেল’ স্থাপন করে।শহরে পৌর খেয়াঘাট, পালবাড়ি গোডাউনঘাট, রমানাথপুর মসজিদ সংলগ্ন পুকুরপাড়, দেউলকাঠি, গাবখান ও খেজুরা গ্রামে বহু নিরিহ বাঙ্গালীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ৭ ডিসেম্বর বিকেলে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় ঝালকাঠি। একইদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয় নলছিটি উপজেলা। পরের দিন ৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি ও নলছিটি শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে মুক্তিকামি মানুষের ঢল নামে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয় ঝালকাঠি ও নলছিটি শহর।
কুমিল্লা : কুমিল্লা মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের এ দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় কুমিল্লা। এদিন বিকেল ৪ টায় কুমিল্লা টাউন হল মাঠে তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা ও কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাক বাহিনীর ২২ রেজিমেন্টের প্রধান ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে। মিত্রবাহিনীর ১১ গুর্খা রেজিমেন্টের আর কে মজুমদারের নেতৃত্বে কুমিল্লা বিমানবন্দরের তিনদিক থেকে আক্রমণ চালানো হয়। সীমান্তবর্তী বিবির বাজার দিয়ে লে. দিদারুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল এবং অপর দুটি দল গোমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরের ভাটপাড়া দিয়ে এবং চৌদ্দগ্রামের বাঘেরচর দিয়ে এসে বিমানবন্দরের পাকসেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। রাতভর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কতিপয় পাকিস্তানি সেনা বিমানবন্দরের ঘাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে কুমিল্লার বরুড়ার দিকে ও ময়নামতি সেনা ছাউনিতে ফিরে যায় এবং কয়েকজন আত্মসমর্পণ করে। একপর্যায়ে পাকসেনাদের বিমানবন্দরের প্রধান ঘাঁটি দখল করে মুক্তিসেনারা। এভাবেই একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর ভোরে কুমিল্লা হানাদার মুক্ত হয়।
চাঁদপুর : চাঁদপুর মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের এদিনে চাঁদপুর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিল। চাঁদপুর থানার সামনে এদিন বিএলএফ বাহিনীর প্রধান মরহুম রবিউল আউয়াল কিরণ প্রথম চাঁদপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
চাঁদপুর জেলায় (তৎকালীন মহকুমা) সর্বশেষ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর লাকসাম ও মুদাফ্ফরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর। যৌথ বাহিনী হাজীগঞ্জ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর চাঁদপুর আসতে থাকলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তি সেনাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
ভারতীয় গার্ড রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ৩১১ তম মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যৌথ আক্রমণ চালায়। দিশে না পেয়ে পাকিস্তান ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বে দু’টি জাহাজে করে নৌ-পথে ঢাকার উদ্দেশ্যে চাঁদপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ট্যাংক ও বিমান আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়। এই ভাবেই ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর শত্রু মুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদপুর পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৩ সালে বড় স্টেশনে ‘রক্তধারা’ নামে বদ্ধভূমি নির্মাণ করা হয়। এরআগে চাঁদপুরের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুশীল, সংকর ও খালেকের নামে ট্রাক রোডে নির্মাণ করা হয় ‘মুক্তিসৌধ’ এবং চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে লেকের ওপর দৃশ্যত ভাসমান মুক্তিস্মৃতি সৌধ ‘অঙ্গীকার’ নির্মাণ করা হয়। চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সম্মুখে এ জেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নামের তালিকা সম্বলিত একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও চাঁদপুর পৌরসভার ৫ রাস্তার মোড়ে পৌরসভার অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় ‘শপথ চত্বর’।
পাবনা : জেলার সাঁথিয়া উপজেলা মুক্ত দিবস ৯ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এইদিনে সাঁথিয়া হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দখলমুক্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এদিন এলাকার সর্বত্র উড়িয়েছিলেন স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর সাঁথিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে থানা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে নন্দনপুর এলাকায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে চুড়ান্ত মোকাবিলায় অবতীর্ণ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পাবনা শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।পরদিন ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করেও সাঁথিয়া পুনর্দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।এ অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া-মাধপুর সড়কের নন্দনপুর-জোড়গাছার মধ্যবর্তী সেতুটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়।সেদিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র বাঁধার মুখে পাকিস্তানি সেনারা আবারও পিছু হটতে বাধ্য হয়।পরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া থানা চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
দাউদকান্দি : দাউদকান্দি মুক্ত দিবস ৯ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এ দিনে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি (বর্তমান দাউদকান্দি-মেঘনা-তিতাস উপজেলা) পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। লঞ্চযোগে পাক সেনারা ঢাকায় পালিয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা মানসিকভাবে দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ইলিয়টগঞ্জ, শহিদনগর ওয়ারল্যাস কেন্দ্রে এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের দাউদকান্দিস্থ ডাক বাংলোতে অবস্থানরত পাক সেনাদের টার্গেট করে উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্ব হতে এক যোগে আক্রমণ শুরু করে। বৃহত্তর দাউদকান্দির মোহাম্মদপুর, ডাকখোলা, গোয়ালমারী, বাতাকান্দি প্রভৃতি এলাকার ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে, পূর্ব দিক হতে মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে পাক সেনারা পশ্চিম দিকে হটতে থাকে।
দাউদকান্দি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম বাসসকে জানান, ৮ ডিসেম্বর রাত থেকে ৯ ডিসেম্বর সকাল ১১ টা পর্যন্ত যুদ্ধের পর পাক সেনারা দাউদকান্দিতে তাদের শেষ আশ্রয়স্থল সড়ক ও জনপথের বাংলোতে উঠে এবং সেখান থেকে লঞ্চযোগে মেঘনা নদী দিয়ে গজারিয়া হয়ে ঢাকায় পালিয়ে যায়। দুপুরে মুক্তিযোদ্ধারা দাউদকান্দি পৌঁছে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত দাউদকান্দিতে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা উড়ায়।
নড়াইল : নড়াইল মুক্ত দিবস ১০ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের এদিনে নড়াইলের মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তদিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের হাত থেকে নড়াইলকে মুক্ত করে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তর করা হয়েছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান, লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিশাল বাহিনী গঠন করে যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। ৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দু’টি জেট বিমান  নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপকভাবে মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে প্রচুর ক্ষতি সাধন করলে নড়াইল শহর জনমানবশুন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের নিকট গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন দোহার উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িয়ারায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলার কারণে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হতে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় গানবোট যোগে ইতনা গ্রামে ঢুকে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।
মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তিকামী হাজার-হাজার মানুষের অংশগ্রহণে নড়াইলে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন অঞ্চলে পাকহানাদারবাহিনী ও তাদের দোসরদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের চলে তুমুল যুদ্ধ।শুধুমাত্র নড়াইল চিত্রা নদীর পাড়ে (প্রধান ডাকঘরের পার্শে) ৩ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে পাকস্তানি মিলিটারিবাহিনী ও রাজাকাররা। এছাড়া নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর গ্রামের তরফদার পরিবারের স্কুল শিক্ষক আতিয়ার রহমান তরফদার, আব্দুস সালাম তরফদার, রফিউদ্দিন তরফদার, মাহতাব তরফদার ও আলতাব তরফদার এবং মোকাম মোল্যা, কাইজার মোল্যা ও মকবুল হোসেন সিকদারকে ধরে এনে নড়াইল শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেতরে গণকবর দেয় পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দূর্জয় আকাংখা নিয়ে সদর থানায় মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে উজির আলী খান, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী ও কালিয়া থানায় ওমর আলীকে এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান, ও কালিয়া থানায় আব্দুল মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে প্রবেশ করেন।অক্টোবর মাস হতে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশীদিন টিকতে পারবেনা। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চাল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডারগণ আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পন না করায় ৮ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ অনেক গ্রুপ একত্রিত হয়ে সম্মিলিত ভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করলে প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহ’র নেতৃত্বে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে এ যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা লোহাগড়ার জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। মিজানুর রহমানের মৃতদেহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে।
এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর বিজয়ের তীব্র আকাংখা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আব্দুল হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালালে পাল্টা আক্রমণে মো. নজির হোসেন মোল্যার নেতৃত্বাধীন বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। ওই দিনই শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পনে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চতুদিক থেকে প্রচন্ড গোলা বর্ষণ শুরু করলে পাকিস্তানি মিলিটারিরা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এখানে একজন পাকিস্তানি মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। শীতের রাতে প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকেন ও জয় বাংলা স্লোগানে-স্লোগানে শহর প্রকম্পিত করে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর দুপুর একটা ১৫ মিনিটে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলে ৫ জন খেতাব প্রাপ্ত হন। তাঁরা হলেন- বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান। পরে ১৪ ডিসেম্বর এ সেক্টরের মেজর মঞ্জুর নড়াইলে আসেন এবং মুক্তি পাগল হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ডাকবাংলো প্রঙ্গনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
ভোলা : ভোলা মুক্ত দিবস ১০ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের এ দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় আজকের দ্বীপ জেলা ভোলা। সেদিন সকালে পাকিস্তানি বাহিনী ভোলা লঞ্চঘাট হয়ে কার্গো লঞ্চ যোগে পালিয়ে যায়। সকালে এ খবর পেয়ে হাজার-হাজার মুক্তিকামী মানুষ ভোলার রাজপথে নেমে আসে। ‘জয় বাংলা’ ‘তোমার নেতা, আমার নেতা’ ‘শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে স্লোগানে মুখোরিত করে চারপাশ। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠেন সবাই।
ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর আসতে শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদারেরা নিশ্চিত পরাজয় টের পেয়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর তাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শহরের ভোলার খালে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের লঞ্চের গতিরোধ করার চেস্টা করে মুক্তিকামী জনতা।
এসময় তারা গুলিবর্ষণ করতে-করতে পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় কার্গো লঞ্চটি ডুবে গেলে ভোলার পাকিস্তানি হানাদেরদের সকল সদস্য নিহত হয়।
এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা এম হাবিবুর রহমান বাসস’কে জানান, ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ে (ওয়াপদা)পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিলো। ১০ ডিসেম্বর রাতে ওয়াপদা ঘেরাও এর পরিকল্পনা নেই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু তারা পরাজয় জেনে আগেই সটকে পরে সেখান থেকে। পরে তাদের পালিয়ে যাবার সময় ভোলার খালে আমরা প্রতিহতের চেষ্টা করি। পাকসেনাদের পালাবার খবরে হাজার-হাজার জনতা রাজপথে নেমে আসে বিজয় উল্লাসে।
তিনি বলেন, পাকসেনারা পালিয়ে গেলে ওয়াপদা থেকে ৩০ জন বিরঙ্গণাকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের চিকিৎসা শেষে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। সবার অংশগ্রহণে বিজয় র্যা লি করি আমরা। এক অন্যরকম আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেদিন।
লাকসাম : লাকসাম মুক্ত দিবস ১১ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বরেই প্রাণ দিয়ে লড়াই করে কুমিল্লা জেলার বৃহত্তর লাকসাম অঞ্চলকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করেছিলেন ৭১ এর রণাঙ্গনের বীর সেনারা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি। ৭১’র যুদ্ধকালীন সময়ে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে বেলতলীতে কয়েক হাজার বাঙ্গালীকে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ মাটি চাপা দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী লাকসাম রেলওয়ে জংশন থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ঘাঁটি করে। এ ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করে এর ৫’শ গজ দূরে বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দিতো পাকহানাদার বাহিনী।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে এদিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লাকসাম থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলো। বতর্মানে কুমিল্লার লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট ও লালমাই উপজেলা নিয়ে ছিলো বৃহত্তর লাকসামের ভৌগলিক অবস্থান। ১৯৭১ এর এই দিনে লাকসাম হাইস্কুল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা নজির আহমেদ ভূঁইয়া সর্ব প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন।
লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারী মজুমদার বাসসকে জানান, যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সন্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু লোক নিহত হয়। এদের মধ্যে মোস্তফা কামাল ও সোলায়মান নামে দুইভাই, মিশ্রির আবদুল খালেক, কামড্ডা গ্রামের আবুল খায়েরের স্মৃতি এখনও ভুলতে পারছেনা তারা। তিনি আরো জানান, পালানোর সময় মিত্র বাহিনী লাকসামের চুনাতী গ্রামে এবং মুক্তিবাহিনী শ্রীয়াং ও বাংলাইশ গ্রামে পাকহানাদার বাহিনীকে মুখোমুখি আক্রমণ করে। এ সকল আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অসংখ্য প্রাণহাণীসহ অনেক হানাদার বন্দী হয়। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ভোরে যৌথবাহিনী বৃহত্তর লাকসামকে শত্রুমুক্ত বলে ঘোষণা করেন।
ওই ক্যাম্প থেকেই চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ অত্র অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা নিয়ন্ত্রণ করতো তারা। ৮ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর বিভিন্ন কমান্ড লাকসামে অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। পরবর্তীতে মিত্রবাহিনী লাকসাম জংশন ও সিগারেট ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। দুই দিন ধরে প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী লাকসাম থেকে পশ্চিম দিকে মুদাফফরগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালিয়ে যায়। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ভোরে যৌথবাহিনী বৃহত্তর লাকসামকে শত্রুমুক্ত বলে ঘোষণা করেন।