সালমান শাহ’র মৃত্যু রহস্য: নিষ্পত্তি হয়নি ২৭ বছরেও


Assroy প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩, ১:০০ অপরাহ্ন /
সালমান শাহ’র মৃত্যু রহস্য: নিষ্পত্তি হয়নি ২৭ বছরেও

প্রয়াত চিত্রনায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ওরফে ইমন ওরফে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে? নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে? সালমান শাহের মা নিলুফার জামান চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরী আত্মহত্যা মানতে নারাজ। ২৫ বছর সন্তানকে লালন-পালনের পর ২৭ বছর যাবত তিনি আছেন বিচারের অপেক্ষায়। বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত ও প্রতিবেদনের পরও সন্তুষ্ঠ হতে পারেননি স্বজনরা। সর্বশেষ আইনি লড়াইটুকু চালিয়ে যেতে চান মা নীলা চৌধুরী। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। 

সালমান শাহের মৃত্যু ও মামলা

সালমান শাহ মারা যান ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। রমনা থানা এলাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ১১/বি ইস্কাটন প্লাজার ফ্ল্যাটে। ওইদিনই রাজধানীর রমনা থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন সালমান শাহের বাবা কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে।  মামলা দায়েরের কয়েক বছর পর ২০০০ সালের ১১ মে তিনি মারা যান। এরপর মামলাটি পরিচালনা করছেন সালমান শাহের মা নিলুফার জামান চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরী।

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন

সালমান শাহ মারা যান ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। মৃত্যুর পর সুরতহাল প্রতিবেদন ও পরে ময়নাতদন্ত করা হয়। সালমান শাহের প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. তেজেন্দ্র চন্দ্র দাস। সালমান শাহের মৃত্যুকে আত্মহত্যাজনিত বলে উল্লেখ করেন। ১৯৯৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নার্গিস আরা চৌধুরী। ১৯৯৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তার চূড়ান্ত মতামতে বলেন, সালমান শাহের মৃত্যুর কারণ তারা নিশ্চিত করতে পারেননি। কারণ ততদিনে তার দেহটি পুরোপুরি পঁচে গিয়েছিল। পরে প্রতিবেদনটি স্থগিত রাখা হয়।

ভিসেরা প্রতিবেদন

সালমান শাহের ভিসেরা প্রতিবেদন তৈরি করেন সহকারী রাসয়নিক পরীক্ষক মুহাম্মদ আব্দুল বাকী মিয়া। তিনি তার প্রতিবেদনে উল্রেখ করেছেন, জব্দকৃত ৪৭ আলামতের কোনোটিতেই কোনও ধরনের রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়নি।

মেডিক্যাল বোর্ডের মতামত

সালমান শাহ’র মৃত্যুর আসল কারণ চিহ্নিত করতে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট পর্যালোচনা করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামসুল ইসলামকে প্রধান করা হয় মেডিক্যাল বোর্ডের। এতে সদস্য হিসেবে রাখা হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আক্তারুজ্জামান এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগমকে। সবগুলো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তারা মতামতে বলেছেন, ‘এই মৃত্যু স্পষ্টতই আত্মহত্যাজনিত।’

সুইসাইডাল নোট

সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর পুলিশ একটি সুইসাইডাল নোট উদ্ধার করেছিল। সেখানে সালমান শাহ লিখেছেন, ‘আজকের পরে যেকোনও দিন আমার মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিস্কে আমি আত্মহত্যা করছি।’  সিআিইডির সহকারী পুলিশ সুপার ও হস্তলিপি বিশারদ সমীর কুমার মুখার্জী হ্যান্ড নোটটি সালমান শাহ’র বলে মতামত দিয়েছিলেন।

চার সংস্থার তদন্ত

মামলাটি তদন্ত করে পুলিশের চারটি সংস্থা। প্রথমে রমনা থানার এসআই মাহবুবুর রহমান এ মামলার তদন্ত করেন। পরে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন মামলাটি পর্যায়ক্রমে ডিবির দুই কর্মকর্তা তদন্ত করেন। তারা হচ্ছেন, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হুমায়ুন কবীর ও এএসপি মো. মজিবুর রহমান।

এরপর মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়। সেখানে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি খালেক-উজ-জামান। সর্বশেষ আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটির তদন্ত করে। এ সংস্থায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন ইন্সপেক্টর মো. সিরাজুল ইসলাম বাবুল। এ তদন্তে তদারকী কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআই’র পুলিশ সুপার শফিউল আজম ও বশির আহমেদ। প্রত্যেকটি সংস্থার প্রতিবেদনেই চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ওরফে ইমন ওরফে সালমান শাহ’র মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করেন।

জুডিশিয়াল তদন্ত

সালমান শাহের মৃত্যুর ঘটনাটির জুডিশিয়াল (বিচারিক) তদন্তও করা হয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) কোর্টের বিচারক ইমদাদুল হক মামলাটির জুডিশিয়াল তদন্ত করেন। তার তদন্তেও উঠে আসে একই চিত্র।

যেসব কারণে বলা হচ্ছে আত্মহত্যা

চিত্রনায়িকা কাজী শারমিন নাহিদ নূপুর ওরফে শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহ’র জুটি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। তখন তাদের মধ্যে অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়। সালমান শাহ’র স্ত্রী সামিরা হক চট্টগ্রাম গেলে নায়িকা শাবনূর দুই দিন সালমান শাহের বাসায় যান। একদিন সারারাত ছিলেন। অন্যদিন রাত ১২টার দিকে চলে যান। সামিরা হক চট্টগ্রাম থেকে এসে জানতে পারেন, নায়িকা শাবনূর বাসায় এসেছিলেন। সালমান শাহের সঙ্গে শাবনুরের এই অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা নিয়ে স্ত্রী সামীরা হকের সঙ্গে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। সালমান শাহ স্ত্রী সামীরা হককে ভালোবাসতেন। একইসঙ্গে শাবনুরের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এ কারণে দাম্পত্য কলহের এক পর্যায়ে সালমান শাহ জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে যান।

প্রথমবার ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফোন করা নিয়ে মা নিলুফার জামান চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীর সঙ্গে ঝগড়া করে নিজ বাসায় ইনোক্ট্রিন ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন সালমান শাহ। দ্বিতীয় দফায় ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির শুটিংয়ের সময় সামিরা হকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেন সালমান শাহ। পরে স্যাভলন খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এসব কারণে তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করেন, সালমান শাহের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। সাক্ষী মো. নাজমুল হুদা ওরফে মুক্ত, রাকিব উদ্দিন খান, মোখলেছুর রহমান ও সুমিতের ১৬১ ধারার জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য জানতে পারেন তারা।

আত্মহত্যার আরও কারণ সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, সালমান শাহের সঙ্গে মা নীলা চৌধুরীর সম্পর্ক ভাল ছিল না। কারণ সালমান শাহের স্ত্রী সামিরা হকের সঙ্গে নীলা চৌধুরীর ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো। এক পর্যায়ে সালমান শাহ অতিষ্ঠ হয়ে সামিরাকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠেন। এরমধ্যে মা নীলা চৌধুরীকে প্রতি মাসে হাত খরচ বাবদ এক লাখ টাকা দিতে হতো সালমান শাহকে। পারিবারিক বিভিন্ন জটিলতার কারণে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলেও মায়ের প্রতি তার অসীম ভালোবাসা ছিল।

আত্মহত্যার আরেকটি কারণ হিসেবে পিবিআইর সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও সামিরা হকের দীর্ঘ সংসার জীবনে কোনও সন্তান হয়নি। সাক্ষী ডলির ছেলে ওমরকে সালমান শাহ সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। আর ওমর বাবা বলে ডাকতো সালমান শাহকে। পরবর্তীতে ওমরকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন সালমান শাহ। কিন্তু ডলির আপত্তির কারণে ওমরকে দত্তক নিতে পারেননি তিনি। ফলে সালমান শাহের সংসার জীবনে সন্তান না হওয়ায় অপূর্ণতা থেকে যায়। এ কারণে সালমান শাহ হতাশ ছিলেন।

আদালতে সাক্ষী ডলি, মনোয়ারা ও জরিনা এর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দি উল্লিখিত বক্তব্যকে সমর্থন করে। আদালতে সাক্ষী ডলি, মনোয়ারা ও আশরাফুল হক ডন-এর ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এসব কারণেই চিত্রনায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সালমান শাহের মৃত্যু পরিকল্পিত কোনও হত্যাকাণ্ড ছিল না।

তদন্ত শেষে পিবিআই যা বলেছে

আদালতের নির্দেশে পিবিআই মামলাটি গ্রহণ করে ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর। পাঁচ দিন পর ২৯ ডিসেম্বর পিবিআই’র ইন্সপেক্টর সিরাজুল ইসলাম বাবুল মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা শাখা ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলা সংক্রান্ত যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণের আবেদন জানিয়েছিল, সেই আবেদনই পিবিআই থেকে জানানো হলো। একইসঙ্গে মামলা সংক্রান্ত জব্দকৃত ফেরৎযোগ্য আলামত সংশ্লিষ্টদের ফেরত দান এবং বিনষ্টযোগ্য আলামত বিনষ্ট করার নির্দেশ দেওয়ার আবেদন করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর ইন্সপেক্টর সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তিনি প্রতিবেদনে যা বলেছেন এর বাইরে তার কোনও বক্তব্য নেই।

কী বলছেন আইনজীবী

চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সালমান শাহ’র মায়ের পক্ষে পরিচালনা করছেন ফারুক আহাম্মদ। এ বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মনে করি এটি হত্যাকাণ্ড। সেটা প্রমাণে আমরা সব ধরনের আইনি লড়াই চালিয়ে যাব। সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী অসুস্থ। তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। প্রায়ই আসেন দেশে। তিনি অসুস্থ থাকায় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন না।’

শিগগিরই তারা আদালতে নতুন কোনও তদন্ত সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করাতে আবেদন করবেন। এক্ষেত্রে তারা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) দিয়ে তদন্ত করানোর আবেদন করবেন বলে জানান।