অর্ধেক নারী অর্ধেক ইশ্বরী উপন্যাসটিকে আহমদ ছফার আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলা হয়। কেননা ছফার জীবনের নানা টানপোড়ন, প্রেম-ভালবাসার ইঙ্গিত পাওয়া যায় অর্ধেক নারী অর্ধেক ইশ্বরী উপন্যাসে।
উপন্যাসের কথক জাহিদ হাসান। জাহিদ হাসান চরিত্রটি ছফা নিজেই। ব্যক্তিজীবনের প্রথম দিকে ছফা ছিলেন রিসার্চ স্কলার; উপন্যাসের কথক জাহিদ হাসানও তাই। ছফার সাথে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল; চিরকুমার, রান্নাবান্না করতে পছন্দ করতেন– এ উপন্যাসে হুবহু চরিত্র প্রফেসর হাসনাত। এভাবে ছফা ব্যক্তিগতভাবে যাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তা ছফা-আগ্রহীদের কাছে মোটামুটি পরিষ্কার এ উপন্যাসে।
উপন্যাসের সেটিং ঢাকা, সময়টা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়।
জাহিদ তার নতুন প্রেমিকা সোহিনী’র কাছে বর্ণনা করছেন তার অতীত সম্পর্কগুলোর কথা। এক্ষেত্রে জাহিদকে দেখা যায় স্পষ্টবাদী চরিত্র হিসাবে। কোন রাখঢাক ছাড়াই জাহিদ তার গল্পগুলো সোহিনীকে শোনান।
কলকাতা থাকা অবস্থায় জাহিদ ঢাকার এক মেয়ের কথা জানতে পারেন। নাম দুরদানা। দুরদানা নামে যেমন কাজে তেমন দুরন্ত! অন্যভাবে বলা যায়, দুরদানার দুরন্তপনার খবর অপর বঙ্গেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সেকালে ঢাকার রাস্তায় শার্ট-প্যান্ট পড়ে বাইসাইকেল চালিয়ে আর্টস কলেজের ক্লাস করতেন দুরদানা। পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করেই ছিল দুরদানার পথচলা। জাহিদ কলকাতা থেকে দেশে ফিরলে চিরকুট লিখে দেখা করতে চান দুরদানার সাথে। দুরদানা সরাসরি চলে আসেন জাহিদ হাসানের হোস্টেলে। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টল। এ হোস্টেলেই জাহিদ-দুরদানার প্রথম দেখা। এ নিয়ে হোস্টেলে ঘটে যায় তুমুল কান্ড। তারপর সম্পর্ক প্রেমে গড়ায়। নানাজনের হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করেও চলতে থাকে তাদের সম্পর্ক৷ যুদ্ধ পরবর্তী দেশে তখন ঘোলাটে পরিস্থিতি, চোরাগোপ্তা হামলা হয় প্রায়ই। এরই মধ্যে খুন হন দুরদানার বড় ভাই ইউসুফ জোয়ারদার। একসময় জাহিদ-দুরদানা সম্পর্ক স্থবির হয়ে পড়ে।
জানা যায় আর্টস কলেজে পড়া সে দুরদানা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন আহমদ ছফার প্রথম প্রেমিকা স্থপতি শামীম শিকদার। আর খুন হওয়া বড় ভাই ইউসুফ জোয়ারদার ছিলেন সর্বহারা দলের বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদার।
অতঃপর জাহিদ সোহিনীকে তার দ্বিতীয় সম্পর্কের গল্প শোনান। এক্ষেত্রে জাহিদের সত্যে-সাহসিকতা অতুলনীয়।
জাহিদের দ্বিতীয় সম্পর্ক হয় প্রফেসর শামারোখের সাথে। শামারোখ ক্যাম্বব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে দেশে ফিরছেন মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিলাতে বিচারপতি আবু সাঈদের চৌধুরীর সাথে শামারোখের দেখা হয়। যুদ্ধ শেষে ইংরেজি সাহিত্যে পড়া শামারোখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের করবেন, নিয়োগপত্র ঠিকঠাক হয়। কিন্তু বাধা হয়ে দাড়ান বিভাগীয় প্রধান। এমনই সময় বিভাগীয় প্রধান শরীফুল ইসলাম চৌধুরী জাহিদকে তার অফিসে ডেকে নেন। জাহিদের সুসম্পর্ক প্রফেসর হাসনাতের সাথে, প্রফেসর হাসনাতের সাথে আবার ভাইস চ্যান্সেলরের ভাল সম্পর্ক৷ শামারোখের নিয়োগ ঠেকাতেই শরীফুল ইসলাম চৌধুরী জাহিদকে প্রফেসর হাসনাতের কাছে পাঠান। কিন্তু কে জানত শামারোখের সাথে জাহিদের বৈরিতার পরিবর্তে মধুর সম্পর্ক গড়াবে? বিভাগের সকল শিক্ষকেরা এ নিয়োগ ঠেকাতে এককাট্টা। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাহিদের নামে অপবাদ ছড়িয়ে যায়। শিক্ষকদের বিরোধীতায় শামারোখের নিয়োগ স্থগিত হয়। এদিকে জাহিদের স্কলারশিপের টাকাও বন্ধ করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান এ রাজনৈতিক কাঠামোর তীব্র সমালোচক ছিলেন আহমদ ছফা।
বাংলা একাডেমিতে শামারোখ- জাহিদের দেখা হয়ে যায়। এই তাদের প্রথম দেখা। তার আরো কিছুদিন পরে শামারোখ জাহিদের হোস্টেলে চলে আসেন। এই আসা মূলত কৃতজ্ঞতাবশত। একসময় তাদের সম্পর্ক প্রেমে রুপ নেয়।
উপন্যাসে দেখা যায়, এরই মধ্যে জাহিদ জড়িয়ে যান বিপ্লবী রাজনীতির সাথে। যোগাযোগ হয় বিপ্লবী কমরেড এনামুল হকের সাথে। জাহিদের জীবনে একসাথে চলতে থাকে প্রেম ও বিপ্লব। যদিও বিপ্লবী রাজনীতিতে তিনি অনিয়মিত হয়ে পড়েন, তবুও তার যোগাযোগ ছিল কমরেড হকের সাথে। গল্পের বর্ণনায় এনামুল হককে মনে হয় বাস্তবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর তাত্ত্বিক গুরু সিরাজুল আলম খান।
জাহিদ- শামারোখের সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের প্রচার-অপপ্রচার চলতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় ও বাইরের এলাকায়। বিলাতি স্টাইলে চলা অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারী শামারোখের প্রতি লোভে কাতর অনেকে। এমনকি হার্ভাড পাশ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আবু তায়েবও। আবু তায়েব একদিকে জাহেদকে বসে আনার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে গোপনে চিঠি লেখেন শামারোখের কাছে। এসবকিছু উপেক্ষা করে, সকলের বিরাগভাজন হয়েও শামারোখের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যান জাহিদ। জাহিদকে নিয়ে নিজ বাসায়, বিভিন্ন পার্টিতে যান শামারোখ। জাহিদ ব্যক্তিগতভাবে এসব পার্টি অপছন্দ করলেও শামারোখের জন্য হাজির হন।
ব্যক্তিগত জীবনে হতাশ, ক্লান্ত শামারোখ একদিন জাহিদের হোস্টেলে হাজির হন। আকস্মিকভাবে জাহিদকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন শামারোখ। জাহিদ পড়ে যান মহাবিপদে; না আছে নিজের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, না আছে শামারোখের। চিন্তায়মগ্ন জাহিদ শামারোখের চাকরির দিকে নজর দেন। তার এক ভাইয়ের সহযোগীতায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে স্থগিত হওয়া চাকরী ফিরিয়ে পান শামারোখ। যোগদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
জানা যায় ইংরেজি বিভাগের প্রধান শরীফুল ইসলাম চৌধুরী আসলে প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি তিন বছরের জন্য বিভাগীয় প্রধান হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। একই বিভাগের শিক্ষক ড. সুরাইয়া খানমকে শামারোখ চরিত্রে পাওয়া যায়। ক্যামব্রিজ পাশ করা ড. সুরাইয়া খানম ‘৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
শামারোখের চাকরিতে যোগদানের পরপরই জাহিদ-শামারোখের দূরত্ব বাড়তে থাকে। কালক্রমে শামারোখের সম্পর্ক গড়ায় তরুণ কবি শাহরিয়ারের সাথে। শামারোখের নতুন সম্পর্কে ব্যথিত হন জাহিদ। ইতোমধ্যে জাহিদের লেখক হিসেবে খ্যাতি অনেক। নিজের প্রথম উপন্যাসের রয়্যালটির টাকা থেকে শাহরিয়ারকে আর্থিক সাহায্য করেন জাহিদ। এজন্য শাহরিয়ার- শামারোখ সম্পর্ক কোনভাবেই মানতে পারেননি তিনি। একসময় দূরারোগ্য ব্যাধিতে পড়ে অল্প বয়সে শামারোখের জীবন থেকে হারিয়ে যান শাহরিয়ার। বাস্তবিক জীবনে এই শাহরিয়ার হচ্ছেন কবি আবুল হাসান। কথিত আছে, কবি আবুল হাসান আহমদ ছফার প্রেমিকার সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন।
এভাবেই সোহিনী’র সাথে দুঃখ কষ্টের বর্ণনা করেন নির্বিকার জাহিদ।
জাহিদ থমকে গেলেও থেমে যাননি রূপবতী শামারোখ। শাহরিয়ারের মৃত্যুর কিছুদিন পরই বিয়ে করেন শামারোখ। জাহিদের ভাষায় ‘অসভ্য’ এক স্বামীকে নিয়ে শামারোখ চলে যান আমেরিকায়। আর এখানেই শেষ হয় আহমদ ছফার অনন্য আত্মজৈবনিক উপন্যাস অর্ধেক নারী অর্ধেক ইশ্বরী।
ঘটনার বর্ণনা ও নাটকীয়তা এ উপন্যাসকে করে তুলেছে সুখপাঠ্। ছফার অন্যান্য লেখার মতই পাঠককে আকড়ে ধরার এক অসাধারণ ক্ষমতা উপস্থিত অনন্য এ উপন্যাসের মধ্যে। লেখক ছফার ব্যক্তিগত জীবন, সম্পর্কের উত্থান-পতন ও তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিবরণী এ উপন্যাসকে উপভোগ্য করেছে, নিশ্চয়ই।
বি.দ্র: উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তবের মানুষ খোঁজতে সহায়তা করেছেন আমার সহকর্মী অনিক বিশ্বাস স্যার ও আমার বন্ধু এ. এইচ. রাজ। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
লেখক : প্রভাষক, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট।
আপনার মতামত লিখুন :