কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি


Assroy প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ৯, ২০২৩, ৮:২১ পূর্বাহ্ন /
কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

কুড়িগ্রাম জেলার অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০২৪ সালের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ভর্তিতে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ এবং লটারির ফলাফল পাশ কাটিয়ে প্রধান শিক্ষকের একক সিদ্ধান্তে ওই শ্রেণিতে পাঁচ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। স্কুলটির ভর্তি কমিটির একাধিক দায়িত্বশীল শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত প্রমাণ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান শিক্ষক জিয়াসমিন আরা হক সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাঁচ শিক্ষার্থী ভর্তি করেছেন। যা সরকারি নির্দেশনার স্পষ্ট লঙ্ঘন। লটারি প্রক্রিয়ার ভর্তি কার্যক্রমে প্রধান শিক্ষকতো বটেই, ভর্তি কমিটিও লটারি প্রক্রিয়ার বাইরে কোনও শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে পারেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০২৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রভাতী ও দিবা শিফটে ক ও খ শাখা মিলে মোট ২২০ শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় লটারির মাধ্যমে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। গত ৩ ডিসেম্বর শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয় । ভর্তি কার্যক্রমের প্রথম দিনেই প্রধান শিক্ষক তাড়াহুড়ো করে পাঁচ শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুপারিশ করেন। এদের কেউই লটারিতে ভর্তির সুযোগ পায়নি। 
এমনকি এক শিক্ষার্থী অনলাইনে আবেদনও করেনি। ভর্তি কমিটির সদস্য শিক্ষকরা এতে আপত্তি জানালে প্রধান শিক্ষক জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন জানিয়ে তাদেরকে ভর্তি করাতে বলেন। পরে ওই পাঁচ শিক্ষার্থীকে প্রভাতী শিফটে ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ক’ শাখায় ভর্তি করা হয়। যাদের মধ্যে চার শিক্ষার্থীর ভর্তি ক্রম ১৪, ১৫, ১৬ এবং ১৭। অপর শিক্ষার্থীর ভর্তি রোল নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ভর্তি কমিটি একাধিক সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘যে পাঁচ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে তাদের নাম কিংবা রোল প্রকাশিত ফলাফলের কোনও পর্যায়ে নেই। তারা কোনও কোটাতেও স্থান পায়নি। কিন্তু প্রধান শিক্ষক কোন বিধি বা ক্ষমতা বলে তাদেরকে ভর্তি করালেন তা বোধগম্য নয়। এতে করে লটারিতে স্থান পাওয়া পাঁচ শিক্ষার্থীর অধিকার হরণ করা হয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘ভর্তি ওই পাঁচ শিক্ষার্থীর মধ্যে চার জন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের চার শিক্ষকের সন্তান। অপর জন বাইরের। তারা শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষক বরাবর ভর্তির আবেদন করে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। প্রকাশিত লটারির ফলাফল তালিকায় তাদের কোনও নাম নেই। লিখিত আবেদনে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোটার (এমই) কথা উল্লেখ করলেও সে কোটাতেও তাদের সন্তানরা স্থান পায়নি। ওই কোটায় অন্য শিক্ষার্থীরা সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ওই পাঁচ শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের করা আবেদনে প্রধান শিক্ষক ভর্তির লিখিত সুপারিশ করেছেন। ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তাদেরকে ভর্তি করাতে বাধ্য হয়েছেন।’

ওই শিক্ষক আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনার পরও এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি সম্পূর্ণ বেআইনি। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রধান শিক্ষক অবসরে যাবেন। ধারণা করছি, অবসরের আগে এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।’

ভর্তি কমিটির এক শিক্ষক বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক জিয়াসমিন আরা স্কুলে যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম করছেন। গত বছরও তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করেছেন। এভাবে তিনি জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণ্ন করছেন। এসবের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীসহ যেকোনও কোটায় শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই অনলাইনে আবেদন করে লটারিতে টিকতে হবে। প্রকাশিত ফলাফলের মেধা তালিকা কিংবা অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম না থাকলে কোনও শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ নেই। তবে সরকারি কর্মচারীর বদলিজনিত কারণে তাদের সন্তানকে বছরের অন্য সময়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ভর্তি কমিটি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারে। কিন্তু সেটাও প্রধান শিক্ষকের একক সিদ্ধান্তে নয়।’

লটারির বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রকাশিত ফলাফলের বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তির কোনও সুযোগ নেই। সরকারি কলেজের শিক্ষকের সন্তান হলেও তাদেরকে অনলাইনে আবেদন করে লটারিতে অংশ নি‌য়ে টিক‌তে হ‌বে। এমন‌কি কোটাভুক্ত হ‌লেও লটা‌রি‌তে টিক‌তে হ‌বে। এর বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি কোনও বৈধ চর্চা হতে পারে না। এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা পরিপন্থি।’

জানতে চাইলে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক জিয়াসমিন আরা হক বলেন, ‘প্রকাশিত লটারির ফলাফলের বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তির কোনও সুযোগ নেই। শিক্ষার্থী ভ‌র্তির বিষ‌য়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি রয়েছে। আমার একক সুপারিশে কাউকে ভ‌র্তির সু‌যোগ নেই। এভাবে কোনও শিক্ষার্থী ভর্তির ঘটনা ঘটেনি। আপনি রবিবার স্কুলে আসেন। আমরা বসে কথা বলবো।’

তবে ওই শিক্ষার্থী‌দের ভর্তি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত একাধিক শিক্ষক ভ‌র্তির বিষয়‌টি নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেন, প্রধান শিক্ষক অসত্য বলছেন। তার লিখিত সুপারিশ ও মৌ‌খিক নির্দেশেই তা‌লিকাবহির্ভূত ওই পাঁচ শিক্ষার্থী‌কে ভর্তি করা‌নো হ‌য়ে‌ছে। তারা প্রত্যেকে ভর্তি ফি জমা দি‌য়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। কিন্তু লটারির ফলাফলের প্রথম দফার মূল তালিকা ও অপেক্ষমাণ তালিকায় তা‌দের নাম কিংবা রোল নেই।

ভর্তি কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘আমি এ ধরনের কোনও নির্দেশনা দেইনি। এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে আমার সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের কোনও কথাও হয়নি। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবো।’