রাজশাহী প্রতিনিধি
২২ বছর ধরে গ্র্যাচুইটির ৫ লাখ ৩২ হাজার ৩২৮ টাকার জন্য বিভিন্ন দফতরে ঘুরছেন রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী নজরুল ইসলাম (৮২)। এমন অবস্থায় তিনবার ব্রেইন স্ট্রোক করেন তিনি। টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারছেন না বলে জানান নজরুল।
রাজশাহী নগরীর দড়িখরবোনা এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। তিনি ২০০১ সালের ৪ এপ্রিল পশ্চিম অঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহীর এইএন/পিঅ্যান্ডডি পদ থেকে অবসরে যান।
আক্ষেপ করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল আমি চূড়ান্ত অবসরে যাই। এরপরে টাকার জন্য আবেদন করি। সেখান থেকে (সংশ্লিষ্ট দফতর) আমাকে বলা হয়, এইভাবে ঘুরলে হবে না। কিছু পয়সা-কড়ি দিতে হবে। তাদের বলি, “দেখুন, এটা আমার বেতনের টাকা। এটা আমার ছেলেমেয়ের হক, আমার পরিবারের হক, এই টাকা আমি দিতে পারবো না।” তখন তারা বলেন, “এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে লাভ হবে না”।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার একটা বন্ধু ছিল, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার। তাকে অনুরোধ করে বললাম, টাকার কথা। সে আমাকে তিন হাজার টাকা দেয়। তিন হাজার টাকা নিয়ে আমি তাকে বললাম, আমি লোন হিসেবে নিচ্ছি, টাকা পেলে আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো। তিন হাজার টাকা আমি সেই ব্যক্তির (সংশ্লিষ্ট দফতরের সেই সময় টাকা চাওয়া ব্যক্তি) হাতে গুনে দিলাম। তার কয়েকদিন পরে গেছি। তিনি বললেন, আপনি ওমুক তারিখে আসেন। গেলাম। তিনি বলেন, “এতে তো হবে না। আরও কিছু টাকা দেন।” আমার কিছু কলিগ ছিলেন, তাদের ধরে বললাম, তিন হাজার টাকা দিয়েছি তার পরেও চাচ্ছে। তখন তাদের কাছে থেকে হাজার পাঁচ-সাতেক টাকা নিয়ে দিয়েছি। এর পরে আমি প্রায় চার মাস ঘুরলাম। তিনি আমাকে বলেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (তৎকালীন) বলেছেন, ৫০ হাজার টাকা লাগবে (সত্য-মিথ্যা জানি না)। আমি বলেছি, দিতে পারবো না। তারপরে আমি বহু ঘুরাঘুরি ও দৌড়াদৌড়ি করেছি।’
টাকার জন্য বিভিন্ন অফিসে ঘুরেও কোন ফল হয়নি উল্লেখ করে নজরুল বলেন, ‘আমি অনেক অনুনয়-বিনয় করেছি। চাকরিজীবনে যেসব জায়গায় কাজ করেছি, তার সব কাগজ দেখিয়েছি। আমি ১৫ থেকে ১৬ জায়গায় কাজের সব প্রশংসাপত্র দিয়েছি। আমার সবই পরিষ্কার, ঠিক আছে। আমি শুধু ঘুরছি আর ঘুরছি। টাকা পাইনি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। প্রধান বিচারপতিকে (বর্তমান ও সাবেক) চিঠি দিয়েছি। আমার কাগজপত্রে আমার চিফ ইঞ্জিনিয়ার (সাবেক) লিখেছেন, “আপনার একটা অডিট অাপত্তি ছিল। সেটি বাদ দিয়ে আপনার টাকা দেওয়ার কথা বলেছি ঢাকার সিজিও অফিসকে।” কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।’
তিনি জানান, তার বড় ছেলে ২৮ থেকে ২৯ বছর বয়সে কিছুদিন আগে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। ছেলেই তার সব খরচ দিতেন। তার স্ত্রী ও আরও সন্তান রয়েছে। এ ছাড়া তার দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা আছে। তারা বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করে। নজরুলের দাবি, ছেলেরা অল্প টাকা বেতন পান। তা দিয়ে তাদের কোনোমতে চলে। তিনি বাড়ি ভাড়া পান সাত হাজার টাকা। আর দুই ছেলে সাহায্য করেন। এমন অবস্থায় কষ্টে দিন যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
নজরুল ইসলামের সরবরাহ করা কাগজপত্রে জানা গেছে,মহাপরিচালক পরিবহন অডিট অধিদফতর, অডিট কমপ্লেক্স (১১ তলা) সেগুন বাগিচা, ঢাকা বরাবর ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর নং-১৫১-জি/১৪৬৯/প:/ক(৪) স্মারক। এর বিষয় ছিল নজরুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত-এইএন/পিঅ্যান্ডডি/পশ্চিম/রাজশাহীর গ্র্যাচুইটির স্থগিত করা অর্থ ফেরত প্রদান প্রসঙ্গে। এতে স্বাক্ষর করেন, নির্বাহী প্রকৌশলী/ পিঅ্যান্ডডি (পশ্চিম) মো. আনোয়ার হোসেন (পক্ষে প্রধান প্রকৌশলী, পশ্চিম, বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহী)। ২০০২ সালের ২৯ এপ্রিল এইএন/অ্যান্ডডি রাজশাহী হিসেবে অবসরগ্রহণ করেছেন তিনি। ইতোপূর্বে তার মাসিক পেনশন মঞ্জুর করা হয়েছে। ১৯৭১-৭২ থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত সব সাধারণ অনুচ্ছেদভুক্ত অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গ্র্যাচুইটির স্থগিতকৃত অর্থ বাবদ ৫ লাখ ৩২ হাজার ৩২৮ টাকা ৯৯ পয়সা ফেরত প্রদান করার জন্য পত্র নং-১৫১-জি/১৪৬৯/ প: ক(চ) ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিপিও/পশ্চিম/রাজশাহীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়। যে পরিপ্রেক্ষিতে সিপিও/পশ্চিম (রাজশাহী কর্তৃক পত্র নং-এস/৭১৯/১৫৪ লুজ (ও) তাং-১৬/০২/২০২১-এর মাধ্যমে এফএঅ্যান্ডসিএও। পশ্চিম/রাজশাহীকে ওই ৫ লাখ ৩২ হাজার ৩২৮ টাকা ৯৯ পয়সা নজরুল ইসলামের অনুকূলে ফেরত প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হলেও কোনো টাকা পাননি তিনি।
এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নিষ্পত্তি করা অডিট আপত্তির বিপরীতে গ্রাচুইটির স্থগিত করা ৫ লাখ ৩২ হাজার ৩২৮ টাকা ৯৯ পয়সা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। টাকার অভাবে জীবনযাপন করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে টাকার অভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না।’
তার স্ত্রী সানিয়া বানু (৬৫) বলেন, ‘আমাদের অনেক কষ্টে দিন যাচ্ছে। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছে। তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাড়ি ভাড়ার সাত হাজার টাকায় মাস চালাতে অনেক কষ্ট হয়। স্বামীর টাকাটা পেলে অনেক উপকার হতো।’
বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আফজাল হোসেনের ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তাই এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :