টেলিকম বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক ভঙ্গুর অবস্থান থেকে ডাটা সেবা, উদ্ভাবনী সমাধান এবং নতুন ব্যবসায়িক ধারণার মধ্যদিয়ে পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।
তারা বলেন, এই কাজের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, পেশাদারিত্ব, গতিশীল পরিচালনা পর্ষদ, সুশাসন এবং জবাবদিহিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা সরকারকে যৌথ-উদ্যোগ (জেভি) বা টেলিটকের আরেকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন, যা অন্যান্য পরিষেবার সঙ্গে পিএসটিএন সেবা প্রদান করে আসছে।
তারা অবশ্য স্বীকার করেছেন বিপুল বিনিয়োগ ছাড়া টেলিটক কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না কারণ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের চারটি মোবাইল ফোন অপারেটরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে টেলিটক।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ১৯ কোটি ২৪ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন, এর মধ্যে টেলিটকের গ্রাহক মাত্র ৬৫ লাখ ৩০ হাজার, অপরদিকে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৮ কোটি ৫০ লাখ, রবির ৫ কোটি ৮৩ লাখ ৬০ হাজার এবং বাংলালিংকের ৪ কোটি ২৪ লাখ ৭০ হাজার।
বৃহস্পতিবার বাসসের সঙ্গে আলাপকালে, রবি আজিয়াটা লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভয়েসের বাইরে গিয়ে টেলিটকের জন্য ডেটা পরিষেবা এবং উদ্ভাবনী সমাধান আয়ের একটি উৎসাহ হতে পারে।
তিনি বলেন, যেহেতু টেলিটক কোনো প্রতিযোগিতায় নেই, তারা ডাটা দিয়ে কাজ চালাতে পারবে কারণ এর ওপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ। টেলিটক হ্যান্ডসেট এবং ডাটাভিত্তিক ভয়েসসহ অন্যান্য উদ্ভাবনী ধারণা সরবরাহ করতে পারে।
এই লক্ষ্যে তিনি ভারতী এয়ারটেলের ট্রিপল প্লে (ফোন, ইন্টারনেট ও কেবল টিভি) পরিষেবাগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, টেলিটক এই ধরনের ধারণাগুলো চিন্তা করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা প্রয়োজন কারণ কোনো প্রথাগত নীতি এখন কাজ করবে না। গতানুগতিক উপায়ে বাজার ধরার চেষ্টা করলে তাতে অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।
অন্যদিকে, সরকার যৌথ উদ্যোগ বা বিটিসিএলের সঙ্গে টেলিটকের একীভূতকরণের কথা বিবেচনা করতে পারে কারণ এটির বিভিন্ন স্তরে মালিকানা রয়েছে (এনটিটিএন, আইআইজির মতো লাইসেন্সের বিভিন্ন বিভাগ)।
তিনি বলেন, যৌথ উদ্যোগ বা একীভূতকরণের মাধ্যমে টেলিটক বিটিসিএলের নিজস্ব ফাইবার ব্যবহারের সুযোগ পাবে, যা বিদেশি বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করতে পারে। এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা গেলে ভালো হবে।
রবি ও টেলিটকের মধ্যে কার্য পরিচালনার পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, একজন সিইও’র পক্ষে টেলিটকে সেভাবে কাজ করা সম্ভব নয় যেভাবে তিনি একটি প্রাইভেট অপারেটরে করতে পারেন। কারণ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কর্তৃত্ব নিধারণ করে এবং তাকে তহবিল দিয়ে ক্ষমতায়ন করে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে এটা সম্ভব নয়, বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কারণ মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সবাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে জড়িত।
তবে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এমন নয় এবং রবি বা অন্যদের ক্ষেত্রে তাদের পরিচালনা পর্ষদের সমর্থন রয়েছে। বাস্তবায়নের কাঠামো ও সুশাসন এসব প্রতিষ্ঠানে খুবই শক্তিশালী থাকে।
মাহতাবের কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে অ্যামটবের সাবেক মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) বলেন, টেলিটকে যেসব কর্মকর্তা কাজ করেন তারা হয় কাজ করতে পারছেন না, নয় কোনো অবস্থাতেই যেভাবে কাজ করা উচিত সেভাবে করছেন না।
তিনি বলেন, টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তাদের চাকরির জন্য কঠোরভাবে জবাবদিহি করতে হবে। অন্যান্য সরকারি অফিসের মতো এটি না চালানো পর্যন্ত এগোনো যাবে না।
এস এম ফরহাদ টেলিটককে যেকোনো স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, টেলিটকের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল বিনিয়োগ কারণ এটি কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো বিনিয়োগ করতে পারে না।
তাছাড়া টেলিটকের অনেক উদ্যোগ বোর্ডে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কারণে এগোতে পারছে না বা সময়মতো বাস্তাবায়ন হচ্ছে না উল্লেখ করে ফরহাদ বলেন, বিনিয়োগ ছাড়া টেলিটক কিছুই করবে না।
টেলিটক বোর্ডের সাবের পরিচালক এবং বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. রফিকুল মতিন বলেন, গতিশীল টেলিটকের জন্য গতিশীল বোর্ডের পাশাপাশি সুশাসন অনিবার্য।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে টেলিটক অনেক ধুমধামের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে এবং সাশ্রয়ী প্যাকেজ প্রদানের মাধ্যমে প্রথম দিকে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করে। একটা সময় ছিল যখন বাজারের শীর্ষস্থানীয় গ্রামীণফোন ভয়েস কলের জন্য প্রতি মিনিটে ৬ টাকা চার্জ করত যেখানে টেলিটক ৪ টাকা নির্ধারণ করত।
বাসসের সঙ্গে আলাপকালে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নুরুল মাবুদ চৌধুরী বলেন, তহবিলের সীমাবদ্ধতা তাদের প্রধান সমস্যা, যা টেলিটককে সব দিক থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
অন্যান্য বেসরকারি মোবাইল অপারেটরদের মতো আমাদের বিনিয়োগ ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তারা অবকাঠামো ও এর উন্নয়নের জন্য মাত্র প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পেরেছে, অপরদিকে মার্কেট লিডার গ্রামীণফোনের পরিমাণ এর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি এবং রবি প্রায় আট গুণ বেশি বিনিয়োগ করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে নুরুল মাবুদ বলেন, যত দ্রুত সম্ভব আরো ১০ হাজার বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস), নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপনের জন্য তারা একটি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন যার মাধ্যমে তারা আরও উন্নত সেবা দিতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে টেলিটকের মোট ৫ হাজার ৬ শ’ টি বিটিএস রয়েছে, আর গ্রামীণফোনের রয়েছে ২১ হাজার ৫ শ’ টি, রবির ১৮ হাজার এবং বাংলালিংকের ১৬ হাজারটির বেশি।
আপনার মতামত লিখুন :