আন্তর্জাতিক ডেস্ক
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল-হামাসের চুক্তি হওয়া চার দিনের যুদ্ধ বিরতির মেয়াদ বাড়াতে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে রয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, ফিলিস্তিনপন্থি সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল করার যে প্রতিজ্ঞা তারা নিয়েছে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি সে প্রচেষ্টাকে পণ্ড করে দেবে। শনিবার (২৫ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই খবর প্রকাশ করেছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি।
গাজা উপত্যকায় টানা দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর কাতারের মধ্যস্থতায় শুক্রবার চারদিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ইসরায়েল ও হামাস। কাতার, যুক্তরাষ্ট্র এবং মিসরের মধ্যস্থতায় চলমান যুদ্ধবিরতিতে গত তিন দিনে ৫৮ ইসরায়েলি জিম্মির বিনিময়ে ১১৭ ফিলিস্তিনি কারাবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। মুক্তি পাওয়া জিম্মিদের মধ্যে ১৯ বিদেশিও ছিলেন।
এই চুক্তির অধীনে চার দিনে হামাসের হাতে বন্দি প্রায় ২৪০ জিম্মির মধ্যে ৫০ জনকে ১৫০ ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হবে। তবে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ ইসরায়েলি বন্দির মুক্তির বিনিময়ে একদিন করে এই যুদ্ধবিরতির মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার চাপ আসছে।
এ বিরতির মাধ্যমে নিজ দেশে ফেরার সুযোগ পাচ্ছে ইসরায়েলি জিম্মিরা। তাই এর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ইসরায়েলেই প্রবল অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিরতির মেয়াদ বাড়ানো মানে হামাসকে পুনরায় সংগঠিত, শক্তি সঞ্চয়, অস্ত্র সরবরাহ এবং যুদ্ধে ফিরে আসার একটি সুযোগ করে দেওয়া।
এছাড়া, এ বিরতির মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। যা গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল সেনাবাহিনীকে পুনরায় আক্রমণ শুরু করাকে বেশ প্রভাবিত করবে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কথা উল্লেখ করে কিংস কলেজ লন্ডনের আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেছেন, ‘সময় সর্বদাই ইসরায়েল এবং আইডিএফের বিরুদ্ধে কাজ করছে।’
এ সংঘাতে ইসরায়েলি বাহিনীর দোটানা অবস্থান নিয়ে এএফপিকে তিনি বলেন, ‘একদিকে, সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সব জিম্মিকে মুক্ত করা যাবে না জেনেও আপনি তাদের সবাইকে মুক্ত করতে চাইছেন। আবার অন্যদিকে, এই যুদ্ধের অগ্রগতির ধারাও আপনি পুরোপুরি হারাতে চান না।’
এসময় তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তত বেশি অধৈর্য হয়ে পড়বে।’
তবে হামাসকে ‘ধুলোয় মিশিয়ে দিতে’ বদ্ধপরিকর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
শনিবার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাদের পরিদর্শনের পর দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট জোর দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধবিরতির সময়সীমা ‘সংক্ষিপ্ত’ ছিল। সশস্ত্র সেনাদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘এতে সপ্তাহ লাগবে না, বড়জোড় কিছু দিন লাগবে, কম বা বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আর কোনও কথা থাকলে তা অস্ত্রের মাধ্যমে হবে।’
দ্বিধার বেড়াজাল
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণে দুর্ভেদ্য সামরিক সীমানা ভেদ করে ব্যাপক হামলা চালায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতে, এ হামলায় দেশটির প্রায় এক হাজার ২০০ নাগরিক নিহত হয়। যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক। ওইদিনই হামাসের হামলার জবাবে গাজায় পাল্টা হামলা হিসেবে অতর্কিত বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এ পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি বেসামরিক নিহত হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার ঝড় ওঠলেও তা আমলে নেয়নি দেশটি।
তবে তেল আবিব ইউনিভার্সিটির মোশে দায়ান সেন্টারের আরিক রুডনিস্কি বলেন, যুদ্ধবিরতি দীর্ঘায়িত করার ‘আসল চাপ আসছে ইসরায়েলের ভেতর থেকে—জিম্মিদের পরিবার থেকে।’
অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে শনিবার তেল আবিবের রাস্তায় মিছিল করেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। এসময় তাদের হাতে ‘এখন, এখন, এখন, এখনই সবার মুক্তি চাই!’ এবং ‘জাহান্নাম থেকে তাদের বের করে আনো’ লেখা প্ল্যাকার্ড ছিল।
এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জিম্মি মুক্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইসরায়েল। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তবে যুদ্ধবিরতি দীর্ঘ করা মানে হামাসকে ‘তার সক্ষমতা পুনঃনির্মাণ এবং ইসরায়েলকে আবারও আক্রমণ করার’ সুযোগ করে দেওয়া।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ‘এটি ভয়ানক একটি দ্বিধার বেড়াজাল—আপনি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন না।’
যুদ্ধবিরতির আলোচনায় প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি। এএফপিকে তিনি বলেন, একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য ‘তাগাদা বজায় রাখা’ প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ‘এটি তখনই সম্ভব যখন শুধু ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকেই নয়, আমাদের সঙ্গে কাজ করা অন্যান্য অংশীদারদেরও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকবে।’
শুক্রবার ইসরায়েলের কট্টর মিত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর ‘সম্ভাবনা বাস্তব’। তিনি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাত সমাধানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ওপর জোর দিয়েছেন।
কিংস কলেজ লন্ডনের ক্রিগ বলেন, ‘সামনের বছর ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে ‘মাসের পর মাসব্যাপী’ দীর্ঘায়িত একটি নিবিড় অভিযোগে মনোযোগ দেওয়া অবকাশ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। সুতরাং বাইডেন প্রশাসনকে একটি বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্র দিয়ে এই সংঘাতের সামাধান হবে না, আপনি এভাবে সফল হতে পারবেন না।’
হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাহের আল-নুনু বলেছেন, ‘নতুন চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য গুরুত্ব সহকারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত’ হামাস।
তবে, এরইমধ্যে শনিবার জিম্মিদের দ্বিতীয় গ্রুপটিকে হস্তান্তর করতে কয়েক ঘণ্টা দেরি করে ফেলে হামাস। ফলে তাদের বিরুদ্ধে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে আনে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলের এমন দাবি অস্বীকার করেছে হামাস।
সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা আভি মেলামেদ এএফপিকে বলেন, ‘হামাস জিম্মিদের নিয়ে একটি দীর্ঘ খেলা খেলবে এবং তা শেষ করবে ইসরায়েলের কাছ থেকে চড়া মূল্য আদায়ের মাধ্যমে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হামাস মনে করেছিল, গাজা উপত্যকায় অনুপ্রবেশের জন্য ইসরায়েলের সরকারের প্রতি অভ্যন্তরীণ সমর্থন নষ্ট হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ চাপ এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে, যেখানে হামাসের অস্তিত্বও অব্যাহত থাকবে এবং চলমান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজাও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
সাবেক এ গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন স্বাধীন মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ইভা কৌলোরিওটিস। তিনি বলেন, ‘চলমান এ যুদ্ধে গাজা উপত্যকার মানবিক ও বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি এবং বেসামরিক হতাহতের পরিমাণ নির্বিশেষে ধ্বংসের মাত্রা যা-ই হোক না কেন; এই সংঘাতের অবসান না হওয়া হামাসের কাছে বিজয় বলে বিবেচিত হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :