স্মার্ট বাংলাদেশে ইন্টারনেট হোক মানবাধিকার


Assroy প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৬, ২০২৩, ৫:৩৪ অপরাহ্ন /
স্মার্ট বাংলাদেশে ইন্টারনেট হোক মানবাধিকার

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল। নতুন প্রজন্মের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দিন বদলের সনদ নিয়ে শুরু করেছিল এক স্বপ্নযাত্রা। বিএনপি-জামায়াত জোট তখন এই নিয়ে উপহাস করেছিল, তারা বলেছিল বাংলাদেশে কোনও যুদ্ধাপরাধী নেই এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ এক অলীক কল্পনামাত্র। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এরপরও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি ও উন্নতির অগ্রযাত্রায় হেঁটে আরও দুইবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েছে।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বরে ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে ভিশন ২০২১-এর যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল, বৈশ্বিক সংকট করোনা মহামারির মধ্যেও তা অর্জিত হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ দেশব্যাপী অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে লক্ষ্য এবার স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি। ডিজিটাল বাংলাদেশের ১৪তম বার্ষিকীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা ২০৪১-এর ঘোষণা দেন। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তিনি ৪টি স্তম্ভ  ঠিক করেছেন, স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে এই স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিকরা হবেন পুরোপুরি টেকনোলজি নির্ভর। বলার অপেক্ষা রাখে না, ডিজিটাল বাংলাদেশে অধিকাংশ সরকারি সেবা এখন অনলাইন পাওয়া যাচ্ছে, এবং ই-গভর্মেন্ট মাস্টার প্ল্যানের আওতায় ২০২৫ নাগাদ যেটা শতভাগে উন্নীত হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে স্মার্ট সিটিজেনদের তৈরি করার নানা উদ্যোগ এখন দৃশ্যমান। আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি এবং সফলভাবে ব্যবহার করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছি, একসাথে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের জন্যে তৈরি করা হচ্ছে। দেশে এখন সক্রিয় মোবাইল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি, ইন্টারনেট ব্রডব্র্যান্ড সেবা শহর ছেড়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছেছে। সরকারের নতুন পরিকল্পনা গ্রাম হবে শহর এখন আর স্বপ্ন নয়। গ্রাম হবে শহর মানে গ্রামগঞ্জে বড় বড় দালানকোঠা উঠবে তা কিন্তু নয়, আধুনিক গ্রাম হবে তথ্য প্রযুক্তি ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থানির্ভর এক গ্রাম, যেখানে গ্রামীণের কৃষকরা আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সকল সুবিধা ব্যবহার করে জীবনের অভূত উন্নতির সুযোগ পাবেন, যার ফলে গ্রামে উৎপাদিত পণ্য সঠিক সংরক্ষণ ও যথাযথ মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সুযোগ্য পুত্র, তথ্য ও যোগাযোগ উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরিকল্পনায় অনেক যুগান্তকারী ডিজিটাল সেবা এখন বাস্তব, যার প্রত্যক্ষ সুবিধা শহর গ্রামের সকল মানুষ পাচ্ছে, যেমন জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯, জাতীয় তথ্য বাতায়ন ৩৩৩, কৃষকবান্ধব কল সেন্টার ৩৩৩১, টেলিমেডিসিন ও ছাত্র ছাত্রীদের জন্যে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম, যা পৃথিবীব্যাপী প্রশংসিত। কাগজের টাকার ব্যবহার কমিয়ে সত্যিকারের স্মার্ট ক্যাশলেস সোসাইটির দ্বারপ্রান্তে আমরা, সম্প্রতি নগদ এবং কুড়ি নামের দুটো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে দেশের প্রথম ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমতিপত্র।  

বর্তমান সরকারের ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখায় সব অর্জনের জন্য যে একটা বিষয় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দরকার তা হচ্ছে ইন্টারনেট পরিষেবা। ১৯৯৭ সালের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রেলওয়ের ফাইবার অপটিক ক্যাবল বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। ইন্টারনেট পৌঁছে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়, এই অগ্রযাত্রা এখনও চলমান, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে। ডিজিটাল বাংলাদেশকে সরকারি সেবা, ক্যাশলেস ট্রানজেকশন, সামাজিক যোগাযোগ, দূরশিক্ষণ, ফ্রিল্যান্সিংসহ নানা কাজে ইন্টারনেটবিহীন একমুহূর্ত কল্পনাতীত। ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তা পৃথিবী খুব সম্ভবত সব থেকে বেশি অনুভব করেছে করোনাকালীন সময়,  করোনা মহামারির কারণে আমাদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ, দূরশিক্ষণ, টেলিমেডিসিন, ব্যাংকিং, সাংবাদিকতা ও নানা ধরনের সামাজিক সেবা দেওয়া-নেওয়ার বিষয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। ইন্টারনেট সেবা থাকাতেই করোনা মহামারির গবেষণা, প্রকাশনা এবং টিকা উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল দ্রুততম সময়ে। তাই ইন্টারনেট প্রাপ্তি এখন আর সুযোগ নয়, অধিকার।

ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার বলতে মূলত বাধাহীন ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ, ইন্টারনেটে  অবাধ তথ্যের ব্যবহার এবং তথ্যের সন্নিবেশকে বোঝায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই ইন্টারনেট এখন মৌলিক মানবাধিকার। ২০০০ সালে উত্তর ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়া সর্বপ্রথম সংসদে আইন পাস করে ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রসঙ্গত, এস্তোনিয়া পৃথিবীর প্রথম ১০টি স্মার্ট দেশের একটি এবং দেশটিতে কাগজের নোট ও অফিসে আদালতে কাগজের ব্যবহার নেই বললেই চলে। পরবর্তীতে আরও অনেক দেশ ইন্টারনেটকে মানবাধিকার হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে ফ্রান্স (২০০৯), ফিনল্যান্ড (২০১০) ও কোস্টারিকা (২০১০)।

জাতিসংঘ কর্তৃক  ইন্টারনেট ব্যাবহারে মানবাধিকারের বিষয়টি প্রথম আলোর মুখ দেখে মানবাধিকার কাউন্সিল রেজুলেশন ১২/১৬, ২ অক্টোবর ২০০৯ এবং জাতিসংঘের মতপ্রকাশ বিষয় বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক লা রুইর ২০১১-এর মতপ্রকাশ বিষয়ক রিপোর্টার ভিত্তিতে। তিনি ৮৮টি সুপারিশ করেছিলেন, যারমধ্যে অনলাইনে মতপ্রকাশ, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, অনলাইন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও ইন্টারনেট প্রাপ্তিকে অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জেনারেল অ্যাসেম্বলি রেজুলেশন ৬৬ /১৮৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১১ সেই সুপারিশগুলোকে নিশ্চিত করে। সাইবার স্পেসে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার চর্চা বিশেষে করে মুক্ত মতামত, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির অধিকার প্রাধান্য পায় তখন। জাতিসংঘ কর্তৃক নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট প্রাপ্তির বিষয়টি যে একটি মানবাধিকার, সেই ঘোষণাটি মূলত আসে ২০১৬ সালে একটা নন-বাইন্ডিং রেজুলেশনের মাধ্যমে।

মানবাধিকার কাউন্সিল ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর) এবং ১৯৬৬ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর)-এর অনুচ্ছেদ ১৯-কে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে এক্ষেত্রে। অনুচ্ছেদ ১৯ বলা হয়েছে, “কোনোরূপ বাধা ব্যতীত মতামত পোষণ করার অধিকার সকলের থাকবে, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই অধিকারের মধ্যে মৌখিক, লিখিত অথবা মুদ্রিত, শিল্প অথবা স্বীয় পছন্দের অন্য কোনও মাধ্যম, তথ্য ও সকল প্রকারের ধ্যান-ধারণা অন্বেষণ, গ্রহণ ও জানানোর অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্টও ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অনুরাধা ভাসিন বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০২০) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯-এর রেফারেন্স টেনে বলেন ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(১) অনুযায়ী মৌলিক মানবাধিকারের অংশ।

প্রসঙ্গত, ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯-এ স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার, মৌখিক, লিখিত, ইলেকট্রনিক ও ব্রডকাস্টিং অধিকারকে বোঝানো হয়েছে।  

বাংলাদেশে ইন্টারনেট প্রাপ্তি এখনও সুযোগ, অধিকার নয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ধারা ২৯ (খ) বলছে, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)-এর অন্যতম কাজ হচ্ছে, বাংলাদেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা অনুসারে যতদূর সম্ভব বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত ব্যয়-সাপেক্ষ ও আধুনিক মানের টেলিযোগাযোগ সেবা ও ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা।  

ইন্টারনেট প্রাপ্তির সুযোগের রেফারেন্স বলতে এতটুকুই, আমি এটাকে আইনগতভাবে ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার বা গণতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচ মনে করি না। আইনের মধ্যে ‘যতদূর সম্ভব’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে এটির বাস্তবায়ন রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্ষমতা ও ইচ্ছের ওপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সহায়ক নয়। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ (চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা) অনেকটা ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ এবং ইউডিএইচআর ও আইসিসিপিআর-এর অনুচ্ছেদ ১৯-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এক্ষেত্রে সরকার অনুচ্ছেদ ৩৯ সংশোধন করে ইন্টারনেটকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে, অথবা কোনও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনলে আদালত তার ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মতপ্রকাশের বিষয়টি শর্তহীন নয়, এবং শর্ত রেখেই ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে মানবাধিকারে হিসেবে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব এবং উচিত বলে আমি মনে করি।

ইন্টারনেট পাওয়া এবং ব্যবহারের সাথে যে শুধু মতপ্রকাশের মতো একমাত্র নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার জড়িত তা নয়, এর সাথে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সুযোগের সমতাসহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।  

পরিশেষে, ভিশন ২০৪১-এর যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি তার বাস্তবায়নে ইন্টারনেট প্রাপ্তিকে সহজলভ্য করার বিকল্প নেই। সহজলভ্যতার পাশাপাশি বিষয়টির সাথে যেহেতু নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে, তাই এর আইনগত নিশ্চয়তা দরকার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যে ১৭টি লক্ষ্য অর্জনের জন্য পৃথিবীর ১৯৩টি দেশ একমত হয়ে একযোগে কাজ করছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮ থেকে ১১ এবং ১৬ ও ১৭ অর্জনের জন্যে শক্তিশালী ইন্টারনেট প্রাপ্তির বিকল্প নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন একইভাবে তিনি স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যও অর্জন করবেন। একমাত্র তার দ্বারাই এ ধরনের নতুন এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। তার নেতৃত্বে তারুণ্যের অংশগ্রহণ ও মেধাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে যে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ রয়েছে  তার সঠিক বাস্তবায়নে এ ধরনের আধুনিক এবং যুগান্তকারী মানবাধিকারের স্বীকৃতিও সম্ভব হবে বলে  আমি আশা করি।