বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) দায়িত্ব নেওয়ার আগেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি দিয়ে আর্থিক সংকটে ফেলাসহ নানা অনিয়মের জালে আবদ্ধ করার ষড়যন্ত্র চলছে। এ ধরনের ১৫টি পয়েন্ট শনাক্ত করে বর্তমান পরিষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন খোকন সেরনিয়াবাত নিজেই।
তবে অভিযোগকালে একবারের জন্যও বর্তমান মেয়র তার বড় ভাইয়ের ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর নাম মুখে আনেননি। খোকন সেরনিয়াবাতের দাবি, মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার আগে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতিতে তাকে জড়ানোর ষড়যন্ত্র চলছে, তা নগরবাসীর জানা দরকার। কারণ নগরবাসী অনেক আশা করে তাকে মেয়র নির্বাচিত করেছেন। বছরের পর বছর ধরে সিটি করপোরেশনের সচিব থেকে শুরু করে চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেটসহ একাধিক কর্মকর্তার পদশূন্য। গত আগস্ট মাসে শূন্য হয়েছে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদও। তবে ওসব পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের ভয়ভীতি দেখানোর কারণে কাজে যোগ দিচ্ছেন না বলে জানান খোকন।
সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে দুবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন জিয়াউর রহমান বিপ্লব এবং ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এনামুল হক বাহার। তারা জানান, চতুর্থ পরিষদে সিটি মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন সাদিক আব্দুল্লাহ। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সিটি করপোরেশনে তেমন একটা আসতেন না। বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড ছিল কালিবাড়ি সেরনিয়াবাত বাসভবনে। এ কারণে সিটি করপোরেশন ভবনের বেহাল অবস্থা। মেয়রের নির্ধারিত কক্ষ থেকে শুরু করে প্রতিটি কক্ষের অবস্থা বেহাল। এমনকি বিসিসি ভবনের ছাদ এবং ভবন ঘেঁষে বড় বড় গাছ জন্মেছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ফাটল। পঞ্চম পরিষদের মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার আগে এসব বেহাল অবস্থা সংস্কারের কাজ চলছে।
সিটি করপোরেশন থেকে চাকরিচ্যুত নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার আগেই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ১০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপর সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর অনুগতদের একাধিক পদ দিয়ে বিসিসির কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সাদিক আব্দুল্লাহ যাওয়ার আগেই কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এছাড়া অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। পরিসংখ্যানবিদ স্বপন কুমারকে পদায়ন করা হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। দুই জন সহকারী প্রকৌশলীকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেক কর্মকর্তা।’
তিনি বলেন, ‘পদোন্নতি দিতে ন্যূনতম নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে চুক্তিভিত্তিক কর্মীর সংখ্যাও। যাতে পঞ্চম পরিষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে না পেরে রোষানলে পড়ে।’
চতুর্থ ও পঞ্চম পরিষদে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে বহুতল ভবনের প্ল্যান পাস নিয়ে। সেখানে একাধিক নিয়ম বেঁধে দিয়ে প্ল্যান পাস করা হয়। এরপর প্ল্যানের সামান্যতম বাইরে গেলে ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ সুযোগে রোড পরিদর্শকরাও প্রতিটি ভবন থেকে চাঁদাবাজি করেছেন। এজন্য আগে যে পরিমাণ ভবন নির্মাণ হতো, চতুর্থ পরিষদের আমলে তার চারভাগের এক ভাগও হয়নি।’
গত পাঁচ বছরে নগরীতে কোনও ধরনের উন্নয়ন হয়নি জানিয়ে নবনির্বাচিত সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বেশিরভাগ সড়কের বেহাল অবস্থা। খাল সংস্কার না হওয়ায় নগরবাসীকে পানিবন্দি থাকতে হয়। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে নগরবাসীকে বেকায়দায় ফেলা হয়েছে। লুটপাটে মেতে থাকতে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। হলুদ অটোরিকশার অনুমোদন দিয়ে নগরীতে যানজট সৃষ্টি করা হয়েছে।’
গত পাঁচ বছর নির্দিষ্ট চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ বলেন, ‘কাজ না করেও ওসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিল উত্তোলন করে নিয়েছে। সড়ক ও ফুটপাতে অবৈধভাবে দোকান স্থাপন করে পথচারী, যানবাহন চলাচলে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। বিসিসির যান্ত্রিক শাখা থেকে কোটি টাকার মালামাল বিক্রি এবং একাধিক গাড়ি অকেজো করে ফেলে রাখা হয়েছে। চেক ও ফাইলের পেছনের তারিখে স্বাক্ষর রেখে ঠিকাদারি কাজের বিল উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফন্দি আঁটছেন সংশ্লিষ্টরা। যাতে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ি। তবে যত ফন্দি আঁটুক তাতে কাজ হবে না। কারণ চতুর্থ পরিষদের দুর্নীতির বিষয়টি নগরবাসী জানে। এ কারণে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে আমাকে সিটি করপোরেশনে পাঠিয়েছে। আমি নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সব দুর্নীতির মোকাবিলা করবো।’
বর্তমানে ষড়যন্ত্র চলছে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের যোগদান নিয়ে উল্লেখ করে সিটি মেয়র আরও বলেন, ‘গত আগস্ট মাসে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহমেদকে বদলির পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত জাকির হোসেন বাচ্চুকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি এখানে যোগদান না করায় ৫ অক্টোবর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উপসচিব এসএম. মুনীর উদ্দীনকে বদলি করে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত সোমবার পর্যন্ত তিনিও যোগদান করেননি। এর আগে অক্টোবর মাসে সচিব পদে নিয়োগ পান মাসুমা আক্তার। তিনি ২০ অক্টোবর বাজেট ঘোষণার দিন উপস্থিত হয়ে ৪৫ দিনের ছুটিতে চলে যান। ওসব কর্মকর্তাকে কে বা কারা ভয়ভীতি দেখানোর কারণে যোগদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জেনেছি।’
অনিয়মতন্ত্রিকভাবে পদায়নের অভিযোগ ওঠা বিসিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। নিজের পদায়নের বিষয়টি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়নি দাবি করে স্বপন কুমার বলেন, ‘অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।’
এসব ব্যাপারে জানতে বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, এবার সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। বিপরীতে তার ছোট চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ মনোনয়ন পান। গত ১২ জুন অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি নির্বাচনে খায়ের আব্দুল্লাহ মেয়র পদে জয়ী হন। আগামী ১৪ নভেম্বর বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে। এরপর নতুন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেবেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ। ওই দিন ব্যাপক আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সিটি মেয়রের অনুসারী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
আপনার মতামত লিখুন :